আলোকচিত্রণ ও সঙ্গীতের কয়েকটি দিক

নিবন্ধ

আলোকচিত্রণ ও সঙ্গীতের কয়েকটি দিক

-শাহিনুর ইসলাম


নকশা

কোন তলে পুনরাবৃত্ত রেখা, আকার অথবা রঙের নিয়মিত বিন্যাসকেই নকশা বা pattern বলে। নকশা আলোকচিত্রে অন্যান্য উপাদানের মতই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ নকশা সংচিত্রিত করেও সঙ্গীতের ছন্দকে আলোকচিত্রে বিধৃত করা যায়। নকশা দর্শকের আবেগগত দিক নিয়ন্ত্রিত করে। তাই নকশার ভারসাম্য অতি স্পষ্ট ও প্রত্যক্ষ না করাই শ্রেয়। বরং নকশায় জটিলতাকে যতো নিপুণতা ও দক্ষতার সাথে ভারসাম্য দেওয়া যায় ততোই ভাল। নকশার রহস্যময়তা ও বর্ণময়তাকে দর্শক ঠিকমত বুঝতে পারলে তাতে নান্দনিক রস আরও বেড়ে যায়।

নকশার যে কতো গুরুত্ব তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে যখন জানা যায় দ্বাদশ ও ত্রয়োদশ শতাব্দীতে চিত্রশিল্প বলতে বোঝাত একটি ধরনকে যাকে বলা হতো প্যাটার্ন। সেই নির্দিষ্ট পথ অবলম্বন করে যে যতো সুন্দরভাবে বিষয়বস্তুকে ফুটিয়ে তুলতে পারত, তা-ই সার্থক শিল্প হিসেবে পরিগণিত হতো। তাছাড়া প্যাটার্ন যে শিল্প সে ধারণা চীনে স্থায়ী রূপ পেয়েছিলো , যদিও শিল্পীর সৃজনশীলতা প্রকৃত শিল্পের পর্যায়ে পৌঁছতে পারেনি।

বস্তুত, পুনরাবৃত্তি, তার মাধ্যমে নকশা এবং পর্যায়ক্রমিক আবর্তন (alternation)- কী কবিতায়, কী সঙ্গীতে, কী অন্যান্য শিল্প মাধ্যমে অথবা প্রকৃতিতে, যেখানেই দেখতে ও শুনতে পাই তা যেন আমাদের অতি কাছে টানে। যেখানেই পুনরাবৃত্তি সেখানেই যেন সাঙ্গীতিক প্রভাব (musical effect) সৃষ্টি হয়। আইজেনস্টাইন বলেছেন, পুনরাবৃত্তি দু’টি উদ্দেশ্য সাধন করতে পারে। একটা হলো- এক অখণ্ড রূপ গঠনে সাহায্য করা, অপরটি হলো- বৈপরীত্যের তীব্রতাকে আরও বাড়িয়ে তোলার উপায় হিসেবে কাজ করা।

কবিতায় একটি বর্ণ বা শব্দ পুনরাবৃত্তির সাহায্যে সাঙ্গীতিক ছন্দময়তা ফুটিয়ে তুলতে পারে। যেমন- ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত তপসে মাছের বর্ণনা দিতে গিয়ে যখন বলেন- ‘কষিত কণক কান্তি কমণীয় কায়’। কিংবা রবীন্দ্রনাথ যখন বলেন- ‘গগনে গরজে মেঘ ঘন বরষা’। তখন প্রথম বাক্যের ‘ক’- এর পুনরাবৃত্তি এবং দ্বিতীয় বাক্যের ‘গ’- এর পুনরাবৃত্তি দর্শকের কানে ছন্দময়তা নিয়ে হাজির হয়। সাহিত্যে ইহা অনুপ্রাস নামে পরিচিত।

আবার বাক্যে শব্দের পর্যায়ক্রমিক আবর্তনও শ্রোতার কানে সুরময়তার আবেশ সৃষ্টি করে। কীটস যখন বলেন- Beauty is truth, truth beauty. তখনও তা ছন্দের গতিকে প্রকাশ করে না কি? তাছাড়াও তা বক্তব্য বা ভাবকে জোরালো করতে সহায়তা করে। প্রকৃতপক্ষে, পুনরাবৃত্তি আমাদের বাস্তবিক জীবনের নানা কথাবর্তায়, চাল-চলনে, আচার-ব্যবহারে ফুটে ওঠে। তবে পুনরাবৃত্তি যেন একঘেয়ে ক্লান্তিকর হয়ে না ওঠে, সে ব্যাপারে সব শিল্পীর চৈতন্যবোধ জরুরী। শিল্প-সাহিত্যে পুনরাবৃত্তি আবার যখন শব্দ, প্রতিমা বা আইডিয়া হিসেবে প্রাধান্য লাভ করে, তখন তা হয়ে ওঠে মোটিফ।

সঙ্গীতে তাল, সুর এবং গানের কথায় পুনরাবৃত্তি যে ছান্দিক ব্যঞ্জনা নিয়ে আসে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। সঙ্গীতে তালের পুনঃপুনঃ আবর্তন থাকে। যে কোন সঙ্গীত পরিবেশনাতেই সমাপ্তি না দেওয়া পর্যন্ত তালের পুনঃপুনঃ আবির্ভাব ঘটে। তালের এই পুনরাবৃত্তিই সঙ্গীতে আবর্তন নামে অভিহিত। তালের এক পূর্ণ আবর্তনকে আবার সঙ্গীতে আবর্ত বলা হয়, যেমন- কাহারবা তালের কথাই ধরা যাক-

                    +সম্        ০ফাঁক         +সম্       ০ফাঁক      +সম্        ০ফাঁক      +সম্

                    I    .   .   . I   .    .    .  I   .   .   . I   .   .   . I  .   .   .   I   .    .     I

                   আবর্ত                     আবর্ত                     আবর্ত

(এখানে সম্  বেশি ঝোঁক বোঝাতে এবং ফাঁক ঝোঁকহীনতা বোঝাতে ব্যবহৃত হয়েছে।)

সঙ্গীতে শুদ্ধ ও বিকৃত স্বর মিলে ১২ টি স্বরেরও কোন কোনটির পুনরাবৃত্তি ঘটে থাকে। আর গানের কথার ক্ষেত্রে তো লক্ষণীয়, গানের স্থায়ী অংশ বারবার ফিরে আসে। তেমনি অন্তরা অংশেরও পুনরাবৃত্তি ঘটে। আবার সুরে সুরে আভোগ হয়ে গানের মূল অংশ স্থায়ীতে ফিরে আসে। বস্তুত, পুনরাবৃত্তি ও নকশা হচ্ছে আলোকচিত্রণ থেকে শুরু করে সকল শিল্প মাধ্যমের অলংকার।

 

কম্পোজিশনের আরও কয়েকটি দিক

প্রথমেই আসি মাত্রা প্রসঙ্গে। মাত্রা সংরচনের উপাদানগুলির পরিমান নির্ধারণে প্রয়োজন পড়ে। তা সে শিল্পে হোক আর নিত্যকার ব্যবহারিক জীবনে হোক। বস্তুত, মাত্রা জ্ঞান ছাড়া বাস্তব জীবন যেমন বিরস, বিরক্তিকর ও বিতৃষ্ণ হয়ে ওঠে, শিল্প-সাহিত্যের ক্ষেত্রেও তা সমানভাবে সত্য। নির্দিষ্ট পরিমান তরকারি পাক করতে কতটুকু লবণ বা মরিচ দিতে হবে, সে সম্পর্কে একজন আদর্শ পাচক  বা পাচিকার সম্যক জ্ঞান থাকা জরুরী। লবণ কম দিলে তা যেমন আলুনি হবে তেমনি বেশি দিলে এত খর হবে যে তা বিতৃষ্ণা ও বিবমিষা জাগ্রত করবে। মরিচ ও লবণের মাত্রার একটু উনিশ-বিশ করে বিশেষ স্বাদ ও আমেজ আনা যেতে পারে। তবে সে-ও বিশেষ বিশেষ রান্নার ক্ষেত্রে। এ মাত্রার আবার কিছুটা হেরফের ঘটে ব্যক্তি, দেশ, কাল, সংস্কৃতি ও জাতি ভেদে। তেমনি সবকিছুর একটি নির্দিষ্ট ধরনের মাত্রা থাকে, যেমন- আদবের মাত্রা অতিক্রম করলে হয়ে যায় বেয়াদব। তাই মাত্রা বা অনুপাত সমন্ধে পুরাদস্তুর জ্ঞান সকল পেশায়, সকল শাখায় এমনকি ব্যক্তিগত আচরণেও জরুরীভাবে আবশ্যক।

আলোকচিত্রণে অনুপাত বলতে বস্তুর উপাদানের পারস্পরিক তুলনামূলক আয়তন এবং অন্যান্য বস্তুর সাথে ঐ বস্তুটির আকৃতির সামঞ্জস্যপূর্ণ বিন্যাসকেই বোঝায়। তবে আধুনিক শিল্পে অনুপাত বা মাত্রার ক্ষেত্রে কড়াকড়ির শৈথিল্য পরিলক্ষিত। এ ব্যাপারে একটা কথা প্রচলিত- ‘শৈল্পিক সৌন্দর্যের ক্ষেত্রে অনুপাতের রূপায়ণে কোথায় যেন একটু অবাক করার মত ব্যাপার থাকে।’ যেমন- ফ্রেমের মাঝখানে বিষয়বস্তুকে অনুপাত অনুযায়ী রাখলেও তা একঘেয়ে ও দৃষ্টিরসহর বলে মনে হবে। তাই ফ্রেমে বিষয়বস্তু কোন্ অবস্থায় রাখতে হবে, কোন্ জিনিসটি বর্জন করতে হবে এবং তা কতটুকু করতে হবে, সে সম্পর্কে আলোকচিত্রীর জ্ঞান, অভিজ্ঞতা ও বোধকে সম্পূর্ণরূপে কাজে লাগাতে হবে। প্রধান বস্তুকে অন্যান্য বস্তুর সঙ্গে এমনভাবে সংস্থিত করতে হবে যাতে নির্দিষ্ট ব্যঞ্জনায় ব্যঞ্জিত হয়ে চোখ মূল বস্তুর দিকে ফিরে আসতে বাধ্য হয়। এ ক্ষেত্রে নকশা, স্থান-বিভাজন ও রুল অব থার্ড বিশেষ ভূমিকা রাখে। তবে তরকারিতে বিশেষ স্বাদ ও ব্যঞ্জনা আনতে যেমন লবণ ও ঝালের খানিকটা হেরফের করতে হয়, তেমনি আলোকচিত্রসহ শিল্পের সকল শাখায় মাত্রাকে খানিকটা কম-বেশি করে বা বিকৃতি ঘটিয়েও বিশেষ আমেজ, দ্যোতনা ও রস সৃষ্টি করা যায়। কারণ বলা হয়ে থাকে খুঁত না থাকলে মহৎ শিল্প হয় না । তবে এ কথা স্মর্তব্য, মাত্রার বিকৃতি ঘটানোর জন্যও মাত্রা সমন্ধে পুরোপুরি জ্ঞান থাকা অতীব প্রয়োজন।

সঙ্গীতের ক্ষেত্রে মাত্রা বলতে সময়ের পরিমানকেই বোঝায়। প্রতিটি সেকেণ্ডকে এক একটি মাত্রা ধরে নিলে মিনিটগুলি হয় এক একটি তাল। আলোকচিত্রেও এভাবে নির্দিষ্ট মাত্রার দূরত্বের বা রঙের সাহায্যে তাল সৃষ্টি সম্ভব। তবে এ কথা স্বীকাযর্, এই তাল সৃষ্টি সঙ্গীতে যতোটা সহজ আলোকচিত্রণে ততো কঠিন। এই তালের সাহায্যেই সাধারণত সঙ্গীতে ছন্দের সৃষ্টি করা হয়। কিন্তু তাল অনেকক্ষেত্রে ব্যবহৃত না হলেও সঙ্গীতে ছন্দ থেকেই যায়। তেমনি আলোকচিত্রে তাল প্রয়োগ না করেও অন্য উপায়ে ছন্দ সৃষ্টি করা যায়। যেমন- রবীন্দ্রনাথের- ‘কৃষ্ণকলি আমি তারেই বলি’ এবং ‘বন্ধু রহো রহো সাথে আজি’ – এ গান দুটিতে কোন তাল নেই। তবে সময়ের অবিরাম গতির অনুভূতি যাকে বলে ছন্দ তা বিদ্যমান। রাগসঙ্গীতে ‘আলাপ’ জাতীয় পরিবেশনায় এবং ‘ঠুংরী’ জাতীয় কণ্ঠ সঙ্গীতে তেমনটি ঘটতে দেখা যায়। কাজেই বলা যায়, ছন্দ বা সুরই যেমন সঙ্গীতে প্রধান তেমনি আলোকচিত্রণে ছন্দ বা সুর বিধৃত করাই মূল ব্যাপার- তা সে বিকৃতি ঘটিয়ে বা মাত্রা ঠিক রেখে যে কোনো উপায়ে হতে পারে।

 

বুনন ও অনুপঙ্খ

আলো-ছায়ার টোনের তারতম্য করে আলোকচিত্রে বস্তুর বুননকে ফুটিয়ে তোলা হয়। বুনন ছবিতে অতিরিক্ত মাত্রা দান করে। বস্তুর স্পৃশ্য গুণ- নরম বা শক্ত, মসৃণ বা অমসৃণ, ভিজে বা শুকনো ইত্যাদি বুননির পরিস্ফুটনে বিধৃত করা যায়। এই বুননিকে ছবিতে তির্যক আলোয় সুস্পষ্টরূপে চিত্রায়িত করা যায়। বুনটের মাধ্যমেই ছবিতে ত্রিমাত্রিক আভাস আনা যায় কারণ তাতে বস্তুর বেধ বা গভীরতাকে ধরা যায়। সঙ্গীতে বিমূর্ত গুণ বেশি থাকার ফলে সেখানে বুননিকে আলোকচিত্রের মতো ধরা যায় না। তবু বলা যায়, সঙ্গীতে কণ্ঠনিঃসৃত বা যন্ত্রনিঃসৃত সুর যখন মোটা ও ভারী রূপে বের হয় তখন তা সুরের গভীরতাকেই ইঙ্গিত করে। তেমনি সুর চিকনরূপে প্রকাশ পেলে তা তুলনামূলক কম গভীরতাকেই তুলে ধরে। বুননির মাধ্যমেও আলোকচিত্রে সাঙ্গীতিক ছন্দময়তাকে ব্যক্ত করা যায়।

ছবিতে মূল বিষয়কে পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে ফুটিয়ে তোলাই অনুপঙ্খ বা detail বলে অভিহিত। ছবিতে বস্তুর যে কারুকাজ থাকে, বিভিন্ন অংশে বিভিন্ন গুণধর্ম বিদ্যমান থাকে, তা যদি ছবিতে সঠিকভাবে চিত্রায়িত করা যায়, তবে সে ছবি অনেক বেশি প্রাণময়তা নিয়ে হাজির হয়। তাই ছবিতে মূল বস্তুর অনুপঙ্খ না থাকলে তা প্রাণের গতিবেগ হারিয়ে ফেলার দরুণ দর্শককে কাছে টানতে ব্যর্থ হয়। আলোকচিত্রণে যেমন প্রাণময়তার জন্য অনুপঙ্খ থাকা জরুরী, তেমনি সঙ্গীতেও। গান গাওয়ার সময় গাতক যখন মাঝে মাঝে কণ্ঠকে কেঁপে কেঁপে সুরকে ফুটিয়ে তোলেন, তখন তা-ই হচ্ছে সুরের কারুকাজ- যা আলোকচিত্রের অনুপঙ্খের সাথে তুলনীয়। এ জন্য কণ্ঠে স্থিতিস্থাপকতা গুণ থাকা জরুরী। কাজেই দেখা যাচ্ছে, সঙ্গীত ও আলোকচিত্রণ কোনভাবেই পৃথক দু’টি বিষয় নয়। আপাতচক্ষে, পৃথকরূপে ধরা দিলেও তারা গুণগতভাবে এক ও অভিন্ন।

স্পেস

স্পেস বা স্থানবিভাজন ছবিতে একটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। গানের ক্ষেত্রে যেমন গায়ক-গায়িকার কণ্ঠের ব্যাপ্তি বা রেঞ্জ অনুযায়ী সপ্তকের ‘সা’ স্বরটি নির্ধারণ করা অবশ্য কর্তব্য, তেমনি ছবির বিষয়বস্তু যেমনটি দাবি করে ঠিক সেভাবেই স্থানবিভাজন করতে হয়। স্থানবিভাজনের জন্য গ্রীক গণিতবিদ ইউক্লিড প্রণীত একটি অমোঘ নিয়ম আছে- যা আজও শিল্পীমহলে সমান আদৃত। সেটি হচ্ছে রুল অব থার্ড- যার বক্তব্য হচ্ছে ছবির ফ্রেমকে সমান নয়টি ভাগে ভাগ করে মধ্যবর্তী চারটি বিভাজনের যে কোন একটির উপর মূল বিষয়কে নির্দিষ্ট ভাবব্যঞ্জনা অনুযায়ী রাখা। এ নিয়মের ব্যত্যয় ঘটিয়েও সুদৃশ্য ও রসপ্রদ ছবি সৃষ্টি করেছেন অনেক আলোকচিত্রী। তবে প্রাথমিকভাবে এ নিয়ম শেখা অবশ্য কর্তব্য। বস্তুত, এ নিয়ম মেনে ছবি তুললে যে কোনো ছবিই দেখতে ভালো লাগে।

এবার আলোকচিত্রের ফ্রেমকে অনুভূমিক বা উল্লম্বভাবে ভাগ করলে তিনটি ভূমি পাওয়া যাবে- পুরোভূমি (foreground), মধ্যভূমি (middle ground) ও পটভূমি (background)। এ তিন অংশকে তুলনা করা যায়, সঙ্গীতের তিন সপ্তক- উদারা, মুদারা ও তারার সঙ্গে। কেননা সরগমের যে কোন একটি স্বর এ তিনটিতে এসে যেমন ভিন্ন দ্যোতনা লাভ করে, তেমনি একই বস্তু ছবির তিন ভূমিতে ক্রমান্বয়ে রাখলে তা ভিন্ন ব্যঞ্জনা নিয়ে আসে। আবার রুল অব থার্ড- এর যে চারটি মূল বিভাজন তাদের সাথে তুলনা টানা যায় ধ্রুপদী বা ধ্রুপদী ধাঁচের গানের চারটি অংশ- স্থায়ী, অন্তরা, সঞ্চারী ও আভোগের সাথে। এ গানে যেমন সুর বারবার স্থায়ীতে ফিরে আসে, তেমনি ছবিতে মূল বস্তু চারটি বিভাজনের যে কোনো একটিতে থাকলে চোখ অপর তিনটি বিভাজন ঘুরেফিরে মূল বিষয়ে ফিরে আসবে।

 

ভারসাম্য

ভারসাম্য হচ্ছে সাধারণত একটি জিনিসের সাথে অপর একটি জিনিসের সমতার পরিমাপ। যখন তা নিছক ওজন মাপার ক্ষেত্রে কাজে লাগে তখন তাকে দাঁড়িপাল্লা বলে আখ্যায়িত করা হয়। কিন্তু সেই ভারসাম্যকে যখন চোখের ও কানের সুখানুভূতি সৃষ্টিতে ব্যবহার করা হয়, তখন তা সমতা হিসেবে থাকে না। তখন তা থাকে একদিকে ভারগ্রস্ত বা ভারযুক্ত হিসেবে। বলা যায়, মূল বস্তুর সাথে ভারসাম্যের জন্য অপর বস্তুটিকে (তা মূল বস্তুর তুলনায় অনেক ছোট হতে পারে) ঠেকনা বা অবলম্বন হিসেবে কাজ করে। ভারসাম্য থাকতে হয় কথায়, থাকতে হয় আচরণে ও কাজে, থাকতে হয় মানসিক প্রবণতায়। নইলে তা যেমন অসংলগ্ন, বেখাপ্পা ও অপ্রকৃতিস্থ হিসেবে দেখা দেয়, তেমনি শিল্পে ভারসাম্য ব্যতীত সৌন্দযের হানি ঘটে। সঙ্গীতেও নির্দিষ্ট ভাবানুভূতি জাগাতে কোনো না কোনোভাবে ভারসাম্য থাকতে হয়। উদাহরণস্বরূপ, রাগ সঙ্গীতে তাল প্রক্রিয়ার ব্যবহারে সম্ ও ফাঁক- এই দু’টি তাল ওজন বা ভারসাম্য বজায় রাখতে ব্যবহার করা হয়। ভারসাম্য সৃষ্টিতে আলোকচিত্রী বা অন্য কোন শিল্পীকে তার নান্দনিক বোধকে কাজে লাগাতে হবে। কেননা আগেই বলেছি, শিল্পে ভারসাম্য বলতে দাঁড়িপাল্লার সমতাকে বোঝায় না।

বৈচিত্র্যে ঐক্য

কথাটির মধ্যে কূটাভাস (paradox) থাকলেও এই ঐক্যের কারণেই পৃথিবী ও মহাবিশ্বের সবকিছু টিকে আছে। জগতে এত যে বৈচিত্র্য অর্থাৎ ভিন্ন ধরনের জড় ও জীব থাকা সত্ত্বেও কোন অস্তিত্ববিলোপকারী দ্বন্দ বা বিরোধ নেই। যা আছে তা-ও ভারসাম্য বজায়ের মধ্য দিয়ে মহাঐক্যকে প্রতিষ্ঠা করতে সচেষ্ট। কাজেই শিল্পেও ঐক্য থাকা জরুরী। তা সে সমধর্মী ঐক্য হোক কিংবা বিষমধর্মী ঐক্য হোক। তবে এ কথা স্বীকার করতেই হবে, সমধর্মী ঐক্যের তুলনায় বিষমধর্মী ঐক্য অধিক বৈচিত্র্যপূর্ণ, সুতীব্র ও অনেক বেশি অভিঘাতী। বস্তুত, এ মহাবিশ্ব টিকে আছে ঐক্য নামক অদৃশ্য বন্ধনের দরুণ। আমরা যে ভিন্ন চেহারা ও গড়নের, ভিন্ন সংস্কৃতি ও সমাজের মানুষ একত্রিত হই, চলাফেরা করি- তা-ও ঐক্য বা অদৃশ্য মায়ার বন্ধনের বদৌলতে। আলোকচিত্রে ঐক্যকে নানাভাবে ফুটিয়ে তোলা যায়- তা হতে পারে জোরালো ও সামঞ্জস্যপূর্ণ নকশায়, বিশেষ কোন বর্ণবিভেদের প্রাধান্যে বা একক কোন বৈশিষ্ট্যের উপর গুরুত্ব আরোপ করে। বর্ণসঙ্গতি- যেখানে পরিপূরক দু’টি রঙ বিরাজ করে, সেখানেও ঐক্য উপস্থিত। সঙ্গীতের যে ভিন্ন সাতটি শুদ্ধ স্বর ও পাঁচটি বিকৃত স্বর তারাও পরস্পর মিলে সুরসঙ্গতি ও সামঞ্জস্য সৃষ্টি করে ঐক্য বজায় রাখে। আবার গীত, বাদ্য ও নৃত্য একত্রে যখন পরিবেশিত হয়, সেখানেও ঐক্যের সৃষ্টি হয়।

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*