আলোকচিত্রণ ও সঙ্গীতে গতি

আলোকচিত্রণ ও সঙ্গীতে গতি

গতি

-শাহিনুর ইসলাম


গতি আলোকচিত্রীক সংরচনের কোনো উপাদান নয় বটে, তবে তা সংরচনে রূপায়িত থাকা আবশ্যক- সে স্থির রূপেই হোক বা গতিশীল রূপেই হোক। রেখাই এই গতিকে নির্ধারণ করে- তা সঙ্গীতের মতো বিলম্বিত লয়, মধ্য লয় না দ্রুত লয়ে চালিত হবে। তাই সঙ্গীতের যে লয় তাকেই আলোকচিত্রের গতি হিসেবে আখ্যায়িত করা যায়। সঙ্গীতে লয়ের প্রয়োজন হয় গীত, বাদ্য ও নৃত্য একত্রে অথবা স্বতন্ত্ররূপে বাজাতে। এই গতি বা লয়কে ঠিক সমান থাকতে হবে। তার ব্যত্যয় ঘটলে প্রলয় হয়ে যাবে। সঙ্গীতে ধীর ভাব ও অনুভূতিকে ব্যক্ত করতে বিলম্বিত লয়ে যেমন সুরকে ধরতে হয়, তেমনি আলোকচিত্রণে ধীর গতি প্রকাশে রেখার সদ্ব্যবহার করতে হয়। এ ক্ষেত্রে রেখাকে আঁকাবাঁকা রেখে সে ভাবটি ফুটিয়ে তোলা যেতে পারে। কেননা চোখের তখন ধীর লয়ের মত ধীরে ধীরে অগ্রসর হওয়ার ফুরসত থাকে। আবার সঙ্গীতের মধ্য-লয়কেও তেমনি রেখাকে বিলম্বিত লয়ের চেয়ে কম বক্র বা আঁকাবাঁকা অবস্থায় রাখলে সে রকম ভাব বিধৃত হবে। আর দ্রুত লয়কে সরলরেখায় বাঁধা যেতে পারে। লয়ের মাত্রা ঠিক না থাকলে যেমন সে সঙ্গীত শ্র“তিনন্দন হবে না, তেমনি গতির মাত্রা সঠিকভাবে চিত্রিত করতে না পেলে সে আলোকচিত্রও দৃষ্টিনন্দন হবে না।

স্থির আলোকচিত্রে গতির বিভ্রম রেখা ছাড়াও কারিগরী কৌশলের সাহায্যে করা যায়। এ ক্ষেত্রে ক্যামেরার স্লো শাটার স্পীড ব্যবহারের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। শাটার স্পীডের সঠিক ব্যবহারিক জ্ঞান আয়ত্ত্বে আনতে পারলে সে ক্ষেত্রে সঙ্গীতের বিলম্বিত লয়, মধ্য-লয় ও দ্রুত লয়কে সংচিত্রিত করা যায়। শাটার স্পীড ছাড়াও গতিকে ধরার জন্য আরও কিছু কৌশল রয়েছে, যেমন- জুমিং ইন এবং জুমিং আউট, স্ট্রোবস্কপিক ইফেক্টে ইত্যাদি। এ ধরনের কৌশল আলোকচিত্রে গতি ছাড়াও এক ধরনের নাটকীয়তা ও আকস্মিকতার অভিঘাত আনে। গতি রেখা ও টেকনিক্যাল ইফেক্ট ছাড়াও সৃষ্টি করা যেতে পারে। তা হতে পারে আয়তনের সাহায্যে, রঙের উপস্থিতির দ্বারা, টোনের বিভিন্ন মাত্রায়, আলোছায়ার তারতম্যে, নকশার সুস্পষ্টতায়, বুননিকে ফুটিয়ে তুলে কিংবা অনুপঙ্খকে চিত্রায়িত করে। এই সব বৈশিষ্ট্য ছবিতে গতিময়তার আভাস প্রদান করে। মূলত, এদের যে কোন একটির সার্থক প্রয়োগের মাধ্যমে আলোকচিত্রিক সংরচনকে অনেক বেশি দৃষ্টিনন্দন, মনোগ্রাহী ও জোরালো  করে তোলা যায়। গতিময়তা না থাকলে একটি ছবি নীরস, একঘেয়ে ও বিরক্তিকর হয়ে ওঠে। তা দর্শককে বেশিক্ষণ ধরে রাখার ক্ষমতা রাখে না। আবার এ কথাও সত্যি যে, গতিময়তা থাকলেই যে তা দর্শককে সহজেই আকৃষ্ট করবে তা নয়। সুদৃশ্য ও দৃষ্টিসুখকর ছবি সৃষ্টিতে গতির সফল প্রয়োগে পারদর্শিতা অর্জন করতে হবে। কেননা কিছু কিছু ফরম্ বা আকার আছে যেগুলো গতির সৃষ্টি করে বটে, তবে তা চোখের জন্য মোটেও প্রীতিকর নয়। এ ব্যাপারে আলোকচিত্রীকে সজাগ থাকতে হবে। কারণ তা শব্দের ক্ষেত্রে বাজখাই, কর্কশ ও বেসুরো ধ্বনির শামিল।

আবার দৃশ্যের মধ্যে গতি যে সবসময় একমুখী হবে তা-ও না। সে দৃশ্যে গতি থাকতে পারে বিপরীতভাবেও, তা সে সরলরেখা, বক্ররেখা বা কৌণিক রেখা যা-ই হোক না কেন। তখন দুই বিপরীত গতির যে মিলন বিন্দু থাকে দর্শকের চোখ ঠিক সেখানেই এসে স্বস্তি পায়। ফলত, সংরচন হয়ে ওঠে অনিন্দ্যসুন্দর ও অনন্যসাধারণ। উদাহরণস্বরূপ, ক্রিকেট খেলায় ফিল্ডার যখন উপর থেকে পড়ন্ত কোন বল ধরতে দু’হাত উপরে তোলেন, তখন বলের গতি নিচের দিকে গতি নির্দেশ করে এবং ফিল্ডারের হাতের গতি উপরের দিক নির্দেশ করে। কিন্তু দর্শকের চোখ তো আর একই সাথে দু’জায়গায় থেকে স্বস্থি পায় না। ফলে দুই গতির কেন্দ্রবিন্দু ফিল্ডারের উপরের গতি নির্দেশক হাতে এসে চোখ থেমে যায়। আরও লক্ষণীয়  বিষয় হলো, একই সংরচনে একাধিক গতি থাকলে সবচেয়ে অদ্ভুত ও অযাচিত গতিটির দিকে দৃষ্টি সর্বাধিক চালিত হয়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, সিগারেট টেনে মুখ থেকে ধোঁয়া নিয়মিত চাকতি আকারে বের করলে চাকতির পুনরাবৃত্তির বিন্যাস যতটা না দৃষ্টি আকর্ষণ করবে, তদপেক্ষা সেই বিন্যাসের পাশে অনিয়মিত আকারে বের হওয়া ধোঁয়া বেশি দৃষ্টি আকর্ষণ করবে অথবা অঝোর বৃষ্টিধারায় যখন বৃষ্টির ফোঁটাগুলো নিয়মিত আকারে পড়ে, তখন তা অপেক্ষা ভূ-পৃষ্ঠে পড়া  ফোঁটাগুলি মাটিতে বাধা পেয়ে আবার উপরের দিকে  উঠতে চায়- তা-র গতি বেশি দৃষ্টি আকর্ষণ লাভ করে।

তবে রেখা বা অন্য কোন উপাদান সৃষ্ট নিয়মিত গতি একটা নির্দিষ্ট জায়গায় এসে যখন গতির ভিন্নতা সৃষ্টি করে তখন ছবিতে তা ভিন্ন অভিঘাত ফেলে দর্শককে একঘেয়েমি ও বিরসতা থেকে মুক্ত করে এবং ছবিতে টেনশনের জন্ম দেয়। সঙ্গীতেও লয়ের ক্ষেত্রে তেমনটি ঘটে। দেখা যায় একই গানে স্থায়ী, অন্তরা, সঞ্চারী ও আভোগ ভিন্ন ভিন্ন দ্যোতনা, আমেজ ও মেজাজ নিয়ে উপস্থিত হয়। বিশেষত, ধ্র“পদীধাঁচের গানের সঞ্চারী অংশে ভিন্নতার স্বাদ ও আমেজ সে কথাকেই স্মরণ করে দেয়। উদাহরণস্বরূপ, মান্না দে-র গাওয়া জনপ্রিয় সেই ‘কফি হাউস’ গানটির মাঝামাঝি যখন শোনা যায়-

——————–

——————–

সেই সাতজন নেই আজ টেবিলটা তবু আছে

সাতটি পেয়ালা আজও খালি নেই

একই সে বাগানে এসেছে নতুন কুঁড়ি

শুধু সেই সে দিনের মালী নেই।

——————–

তখন তা কি শ্রোতার জন্য গানের অন্যান্য অংশ থেকে ভিন্ন এক ভাল লাগার আবহ সৃষ্টি করে না? এভাবে গতির ভিন্নতাকে তুলনা করা যায় সঙ্গীতের আরোহী বা অবরোহী গতিতে এক স্বর হতে অন্য স্বরে পৌঁছানোর সময় শেষের স্বরে ধাক্কার বেগ যাকে বলা হয় ‘গমক’, তার সাথে। গতি কখনো রেখার সাহায্যে সঙ্গীতের স্পর্শ স্বর যেমন- মর, পম এর মত ছুঁয়ে যায়, কখনো হয়ে ওঠে পুরো সচল, কখনো আবার ভিন্ন বাঁককে পছন্দ করে। বস্তুত, গতি যদি শুধুমাত্র সরলরেখা আকারে শিল্প সংরচনে চিত্রিত থাকে, তবে তা নীরস হয়ে ওঠে। সে ক্ষেত্রে গতির বাঁক অধিকতর আনন্দ প্রদানে সক্ষম।

পথ এঁকেবেঁকে চলে বলেই তা আমাদের এত কাছে টানে, তেমনি নদী চলার পথে বাঁক নেয় বলেই তা এত মনোরম। আবার নারী শরীরে কমনীয়তা ছাড়াও বাঁক বা ভাঁজ বেশি থাকে বলেই তো পুরুষ দেহ অপেক্ষা অধিকতর সুন্দর। এ ক্ষেত্রে বিরতির কথা উল্লেখযোগ্য, সংরচনে কিছুটা আড়াল ও বিরাম না থাকলে তার রসগর্ভ হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে ঘাটতি থেকে যায়। গান গাইবার সময় যেমন লয়সহ কোণ স্বরে কিছুক্ষণ থামতে(দম) হয় এবং লয়ের সাথে সাথে সুরের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিরাম(খম) নিতে হয়, আলোকচিত্রসহ শিল্পের সকল শাখায় তা প্রযোজ্য।

আবার বলা যায় তবলচি তবলায় বাড়ি দিতে দিতে যখন ইচ্ছাকৃত সামান্য বিরতি দেন, তখন অনুচ্চারিত সুরটি শ্রোতা ঠিকই বুঝে নেয়, ফলে তা আরও আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে। বস্তুত, তা সবক্ষেত্রে সমান সত্য। বিরতি বা বিরাম(বাঁক) না থাকলে যেমন নদী অত সুন্দর হয়ে ধরা দিত না, তেমনি মানুষের জীবনে অনবরত প্রেমের ধারায় যদি ছোট খাট বিরহ না থাকত, তবে তা-ও অতটা মধুর হয়ে দেখা দিত না। বিরামহীন কথা শ্র“তিকটু মনে হত তা যতই মূল্যবান হোক না কেন। কাজেই গতির পাশাপাশি গতিহীনতাও সমান গুরুত্বপূর্ণ। আবার একই গতির বা আবহের উপাদানগুলির একটি ক্ষুদ্র অংশে ভিন্ন গতির সঞ্চার করে কিংবা ভিন্ন রঙ আরোপ করেও বিরচনকে রসময় ও গতিময় করে তোলা যায়- আলোকচিত্রণে যাকে বলে breaking the harmony. এ হচ্ছে একই পৃষ্ঠায় কোন ভাষার শব্দমালার (যেমন- বাংলা ভাষা) গাঁথুনিতে ভিন্ন ভাষার (যেমন- ইংরেজি ভাষা) দু’একটি শব্দ থাকার মত যেখানে পাঠকের দৃষ্টি আগে চলে যায়।

সরলরেখাও নিছক একরৈখিক ছন্দময়তাকে ছাড়িয়ে কখনও কখনও আনন্দ দিতে সক্ষম। দৃষ্টান্তস্বরূপ, একাধিক সরলরেখা যখন দূরে কোন বিন্দুতে মিলিত হয় বলে দৃষ্টিভ্রম ঘটে, তখন তা দৃষ্টির কাছে নান্দনিক রস সৃষ্টি করে। মনে হয়, দর্শকের মন সেইসব রেখার জলপথ ধরে সাঁতরাতে সাঁতরাতে দূরে কোথাও একটি নির্দিষ্ট বিন্দুতে অবগাহন করে। একে বলে কনফিগারেশন। ঠিক যেমনটি ঘটে রেললাইনের সমান্তরাল রেখা দু’টির ছবি তুললে- যেখানে রেখা দু’টি দূরে কোনো এক বিন্দুতে মিলিত হয়েছে বলে মনে হয়। ফলত, তা চোখের কাছে অধিকতর প্রীতিকর প্রতিভাত হয়। তাই বলা যায়, যুগে যুগে যেমন নিয়ম প্রণীত হয়েছে, তেমনি নিয়মের ব্যত্যয়ও রয়ে গেছে।

আবার নিয়মকে ভঙ্গ করেও সুন্দর সুন্দর ছবি সৃষ্টি হয়েছে।  বিখ্যাত আলোকচিত্রীদের ছবি সে কথাই প্রমাণ করে। সঙ্গীতের ক্ষেত্রেও দৃশ্যগত এই কনফিগারেশন পাওয়া যায়। ধরা যাক, কয়েকটি বাদ্যযন্ত্র একটি সুরকে ফুটিয়ে তুলতে একই সাথে তাল-মাত্রার হেরফের করে বাজানো হলো। ফলে সুরটি কল্পনা করলে পরিশেষে একটি নির্দিষ্ট বিন্দুতে মিলিত হয়েছে বলে মনে হবে। সে কারণে নিয়ম জেনে, নিয়ম আত্মস্থ করে বোধকে শাণিত করতে তৎপর হওয়া প্রতিটি শিল্পীরই অবশ্য কর্তব্য। আর আলোকচিত্রণে যেহেতু কারিগরী কৌশলের দিকটা অতীব গুরুত্বপূর্ণ, সে কারণে তা সম্পর্কে জ্ঞান থাকাও জরুরী। অন্যথায়, বোধ যতই শাণিত হোক, তা সফল  আলোকচিত্র হিসেবে রূপ লাভ করবে না।

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*