আমার হলো সারা

আমার হলো সারা

আমার হলো সারা

-সেলিম মিয়া


সুজাতা আমাকে হয়তো পছন্দ করতো। আমি তার সম্পর্কে আগে থেকে জানতাম না শুধু তার অস্তিত্ব ছাড়া। সেও যে আমার সম্পর্কে খুব জানতো তা মনে হয় না। তবে শুরুর দিকে দুজন দুজনাকে যতটুকু জানি তার মধ্যে সে-ই আমাকে বেশি জানতো। আমার প্রতি তার যতটুকু কৌতূহল ছিল তা তৈরি হয়েছে এক রকম গল্প শুনে শুনে। গল্পগুলো শুনেছে অবশ্য তার বড় বোনের কাছে।

সুজাতার বড় বোন আমার পাশের বাসায় থাকতো। নাম মিয়ন্তি। প্রতিবেশি হিসেবে তার সাথে পরিচয় হয়নি, হয়েছিল শপিং মলের এক দোকানে। আর ঘনিষ্ঠতা জন্মে কর্মসূত্রে এবং সেই অজুহাতে তাদের বাসায় ও এখানে-সেখানে বারবার দেখা হওয়ার ফলে টুকটাক কথাবার্তার মাধ্যমে। সরাসরি সহকর্মী না হলেও একই কফি শপের কাছাকাছি অন্য শাখায় প্রথম তাকে দেখি। সেবার কোনো কথা হয়নি। তখন শুধু চেহারা-সুরুতের ভূগোল দেখে বাংলাদেশের মানচিত্রে পড়বে বলে ধরে নেই। পরের বার এক সপ্তাহান্তে শপিং মলের একটা  দোকানে প্রথম যখন কথা হয় তখন নিশ্চিত হই আমার ধারণাই সঠিক। কথা হয় অবশ্য যখন তিনি ছোটখাটো একটা বিপদে পড়েন।

তিনটা শীতের জ্যাকেট, দুই জোড়া বুট ও বাচ্চাদের জন্য কিছু জিনিসপত্র কেনার পর যখন তিনি দোকানে লম্বা লাইনে দাঁড়ান মূল্য পরিশোধ করার জন্য তখন হঠাৎ আবিস্কার করেন যে, তিনি তার ওয়ালেটটা বাসায় ফেলে এসেছেন। সেদিন ঐ মলে আমিও শীতের এক জোড়া স্নো-বুট কিনি। ঘটনাক্রমে লাইনে তার পিছনেই দাঁড়াই, যদিও বিষয়টি তিনি খেয়াল করেননি। আর করবেনই বা কীভাবে? তিনি তো আমাকে কখনো দেখেননি। অচেনা মানুষ যত কাছেই থাক তার সাথে কখনো চেনা মানুষের মতো মেশা যায় না। আবার হয়তো-বা কাছ দিয়ে ঘেঁষে গেলেও নজরেই পড়ে না।

টাকার জন্য তিনি যে তার স্বামীকে ফোন করে আসতে বলবেন সেই মুঠোফোনও আনতে ভুলে গেছেন। বোধ হয় বিশেষ ছাড়ের কারণে খুব তাড়াহুড়া করে বাসা থেকে বের হয়েছেন। দোকান থেকে ফোন করতে চাইলে অবশ্য দোকানি ফোন করতে দেবে নির্দ্বিধায়। কারণ এসব টুকিটাকি ব্যাপারে সাহায্য করার ক্ষেত্রে কানাডিয়ানদের একটা খ্যাতি আছে। কিন্তু বক্সিং ডে’র বিশেষ ছাড় থাকার কারণে ভীড় কয়েক গুণ বেড়ে গেছে। দোকানির নিজেরই ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা। এক্ষেত্রে তার কাছে ফোন করতে অনুরোধ করাটা একেবারে অন্যায়।

আমি মিয়ন্তির বেগতিক অবস্থাটা নিজ থেকেই বুঝি। লম্বা লাইনে একমাত্র সে-ই কিছুটা চেহারায় চেনা। কাজেই ওখানে ঐ অবস্থায় মনোযোগ তার দিকে যাবে—এটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। আগ বাড়িয়ে তাকে বলি, ‘মে আই হেল্প ইউ?’ তিনি কিছুটা আড়ষ্টতায় ভোগেন আমার কথা শুনে। প্রত্যাখান করে বলেন, ‘সো কাইন্ড অব ইউ। নো, থ্যাঙ্কস’। মনে মনে বলি—এখানে কেউ নেই সাহায্য করার মতো। সবাই নিজেকে সামলাতে ব্যস্ত। তার সংক্ষিপ্ত দু’টো বাক্য শুনে আমার বেশ মনে হলো যে, ইনি তো বাংলাদেশি টানে ইংরেজি বলছেন। ‘থ্যাঙ্কস’ এর ‘থ’ কেও উচ্চারণ করছেন বাংলার দন্ত্যমূলীয় ধ্বনি হিসেবে। তবে আমি পুরোপুরি নিশ্চিত নই। বাংলাদেশের নাও হতে পারে।

কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে রই। লাইন কমছেই না। সবাই মনে হয় সব কিছু বাদ দিয়ে আজকেই কেনাকাটায় বের হয়েছে। এর দু’মিনিট পর কী ভেবে যেন তিনি পিছন ফিরে তাকান। তার চোখে মুখে নিরুপায় ভাব লক্ষ্য করি। এবার তিনিই অনুরোধ করেন। যোগাযোগ স্থাপনের ভিত আগে রচিত হলে সে ভিতেই যোগাযোগ করে মানুষ স্বস্তি পায় বোঝা গেলো। আমার ফোনটা চেয়ে বলেন, ‘ক্যান আই বরো ইউর ফোন ফর এ সেক?’ ‘শুওর’ বলেই হাতের ফোনটা তাকে দেই। ফোনটা পেয়েই তিনি তার স্বামীকে ফোন করে নিজের বিপদগ্রস্ত অবস্থার বর্ণনা দিচ্ছেন। কথা বলার সময় তার প্রথম উচ্চারিত কথাটাই আমার পূর্ব ধারণা বা সন্দেহকে সঠিক প্রমাণিত করে। আমি মনে মনে পুলকিত হই নিজের ধারণা সঠিক হয়েছে বলে। কথা শেষ করে ‘থ্যাঙ্ক ইউ সো মাচ’ বলে যখন তিনি মুঠোফোনটা আমাকে ফেরত দেন, তখন তাকে অবাক করে দিয়ে বাংলায় বলি, ‘আপনাকে স্বাগতম’। বিপদজনিত উৎকণ্ঠার কারণে তিনি হয়তো আমাকে এতক্ষণ সেভাবে খেয়াল করেননি। তাই অন্য দশজনের মতো আমাকেও চির-অচেনা হিসেবে ভেবে নিয়েছেন। তবে আমার ছোট বাক্যটি তার মনে অনেক গভীর প্রভাব ফেলেছে বলে মনে হয়। হয়তো উদ্ভ্রান্ত নাবিক সমুদ্র তীর দেখতে পেয়েছে অনেক দূর থেকে।

তিনি তার স্বামীকে ফোন করে আসতে বলেছেন ঠিকই। কিন্তু তিনি অনলাইনে অন্য দেশে শিক্ষা দান করছেন। এ কাজ শেষ করে আসতে তার তিন ঘন্টার মতো লাগবে।

এরপর কত দিন হলো এখানে, এখানকার ভাল লাগা, মন্দ লাগা—এসব নিয়ে বেশ কিছুক্ষণ আলাপ করি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে। লাইনে দাঁড়িয়ে থাকার বিরক্তি অনেকটা কমে যায় দুজনার। এবার জিনিসপত্র দোকানিকে দিয়ে মূল্য পরিশোধ করার পালা তার। আমি তখন দোকানিকে বলি যে, আমি ওসবের মূল্য পরিশোধ করবো। তিনি আপত্তি করতে গিয়েও করলেন না। কারণ স্পষ্ট। আমার বুটের দাম দেওয়ার পর তিনি আমার কাছ থেকে ফোন নাম্বার ও বাসার ঠিকানা চেয়ে নেন এবং অশেষ কৃতজ্ঞতা জানান। বাসার ঠিকানা পাওয়ার সাথে সাথে তিনিই চমকে গিয়ে জানান—আরে, আমি তো এর পাশের বিল্ডিংয়ে থাকি। গন্তব্য এক হওয়ায় এক সাথে দুজন মল থেকে বেরিয়ে একই বাসে উঠে পড়ি।

বাসে করে বাসায় যেতে লাগবে আধা ঘন্টা। আবার যেন আরও একটু কথা বলার ফুরসত মিললো। আরও পরিচিত হওয়ার সময় পাওয়া গেলো। হলোও তা-ই। বাস থেকে নেমে আবার ধন্যবাদ দিয়ে তিনি খুব করে তাদের বাসায় যেতে বলেন। আমি বলি—আজকে পারবো না। অন্য একদিন সময় করে যাবো। আর এখন তো বাসা চিনলাম। এক ছুটির দিনে ঠিকই হাজির হবো। তখন তিনি জানান—অবশ্যই আসবেন। আর বাসা থেকে আপনার টাকাটা আমি এক্ষুণি আমার স্বামীকে দিয়ে পাঠিয়ে দিচ্ছি। ভদ্রতাবশত আমি বলি—এখনই দিতে হবে না। আপনার সুবিধামত সময়ে দিয়েন।

এরপর তাকে প্রায়ই দেখতাম কফিশপে কাজ করতে। সেখানেই কাজ শেষে কথাবার্তা চলতো। আবার কখনো কখনো একই সাথে বাসে দেখা হয়ে গেলেও কথা হতো। বার বার বলার পর এক ছুটির দিনে তার বাসায় দাওয়াত খেতে যাই। নানা পদের রান্না করে রেখেছেন। বেশিরভাগই  হয় দেশি খাবার নয় দেশি পদ্ধতিতে রান্না: আলু ও বেগুন ভর্তা, ডাল, স্যামন মাছ ভাজি, বাসা ফিলের সাথে ফুলকপি, তন্দুরি চিকেন, গরুর মাংস ও সালাদ। এছাড়া রয়েছে দই ও মিষ্টি এবং শেষে লাল চা। খেতে খেতে তার স্বামীর সাথেও কথাবার্তা হয়। মনে হলো আমাকে তাদের মনে ধরেছে।

দিন যায়, ঘনিষ্ঠতা ও সম্পর্ক অনেক মজবুত হয় তাদের সাথে। এরপর সময় পেলেই তাদের বাসায় গিয়ে আড্ডা দেই। এ আড্ডা উভয় পক্ষের জন্য বেশ উপভোগ্য হয়ে ওঠে ধীরে ধীরে। যেদিন তাদের বাসায় যাওয়া পড়ে না, সেদিন খুব মনে পড়ে তাদের। তাদেরও মনে পড়ে বেশ। সেটা বুঝি কারণ তারা তখন ফোন করে আমার খোঁজখবর নেন। বেশ কয়েক মাস এভাবে চলার পর তারা দুজনই আমার আত্মার খুব গভীরে স্থান পান। তাদের মনে আমিও হয়তো তা-ই।

বলতে গেলে আমি একটু একটু করে কীভাবে যেন পুরোপুরি তাদের দখলে চলে যাই। আমার মনোজমিনে তাদের অধিকার ক্রমে ক্রমে অঙ্কুরিত হয়ে ফুল-ফল হিসেবে প্রস্ফুটিত হয়। তাদের কোনো অনুরোধ-উপরোধ কিংবা সাধারণ আবদারও আমার দিক থেকে প্রত্যাখাত হয় না। তাৎক্ষণিকভাবে কোনো আহবানে ‘না’ বললেও পরে ফোন করে ঠিকই তাতে সাড়া দেই। যদিও বুঝি কিছু কিছু আহবান আমার জন্য ক্ষতিসাধন করবে, তবু কিছুতেই ‘না’ বলতে পারি না। আমার হাসি-কান্না, ভাল লাগা, মায়া-মহব্বত—সবই যেন তাদেরকে কেন্দ্র করে।

মাঝে মাঝে এর কারণ অনুসন্ধান করি। করে যা পাই তা হলো—হয়তো বা এই ভিন দেশে এত আপন করে কেউ মেশেনি, কেউ এত যত্ন করে খাওয়ায়নি, আর কারও সাথে কথা বলে মনের এত মিল পাইনি, কেউ নিবিড়ভাবে এত সময় দেইনি, কারণে-অকারণে বিরক্তি সয়নি।

তাদের সাথে আড্ডাবাজির সময় তারা তাদের পারিবারিক খবরাখবর ও দুঃখ-কষ্টের কথা আমার কাছে বলতেন। তখন মনোযোগ দিয়ে শুনতাম। আর ভাবতাম যে, নিশ্চয়ই আমাকে অতি আপন ভাবেন। তাই নিজেদের পরিবারের কথা আমাকে শোনান। আড্ডাবাজির শেষ কয় মাস আমাকে প্রায়ই বলতেন—চলেন দেশে যাই। আপনারে বিয়ে করিয়ে নিয়ে আসি। আমি প্রতি বারে শুধু ইয়ারকি করে তা উড়িয়ে দিয়ে উত্তর করতাম—বিয়ে-শাদী করবো না। অনেক ঝামেলা!

একদিন মিয়ন্তিদের এক দেশি বন্ধু যার সাথে এক মাস আগে পরিচয় তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করেন—বিয়ে করবো কিনা। আমি অভ্যাসবশত ‘না’ বলি। তিনি আর এ বিষয়ে কথা বাড়ান না। এর এক সপ্তাহ পর আবার দেখা হলে তিনি তার মুখখানায় একটা গুরুগম্ভীর ভাব এনে আমায় ইনিয়ে-বিনিয়ে একই কথা জিজ্ঞেস করেন। এবার আমি সরাসরি ‘না’ বলি না। একটু কূটনৈতিকভাবে উত্তর দেই—ঠিক আছে ভেবে দেখি। জানাবো।

বাসায় এসে বিয়ে সম্পর্কে কিছুটা ইতিবাচক ভাবনা মাথায় আসে— বিয়ে করলেই তো এখানকার জীবন বর্তমান অবস্থার চেয়ে সহজ হবে; একজন সঙ্গী জুটবে; একাকীত্ব থাকবে না; কথা বলা যাবে; কারণে অকারণে ঝগড়াও করা যাবে; দুজন কাজ করলে আয়ও বেশি হবে। এত ভেবে মনে মনে কিছুটা রাজি হই। সেই রাতেই একটা ফোন পাই তার কাছ থেকে তার বাসায় এক বেলা খাওয়ার আমন্ত্রণ জানিয়ে।

পরদিন সামাজিক রীতি রক্ষার্থে এবং দাওয়াত খাওয়ার খানিক উদ্দীপনায় তার বাসায় হাজির হই। আমার ধারণা ছিল আরও কেউ আসবে। কিন্তু গিয়ে দেখি বাইরের লোক বলতে শুধুই আমি সেখানে। খাওয়া শেষে সোফায় বসে আয়েশি চা পান করতে করতে তিনি আমাকে বলেই ফেলেন—বিয়ে করবেন? পাত্রী আছে। আপনিও চেনেন। আমি চিনি— কথাটা শুনে আমার কৌতূহল বেড়ে যায়। মনে মনে মেলাচ্ছি একজনের সাথে। তর সইতে না পেরে তিনিই বললেন মিয়ন্তির ছোট বোন সুজাতার কথা। এ কথা বলে তিনি আমার ধারণাকেই পাকাপোক্তভাবে প্রকাশ করলেন।

আমি দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়ি। মনে মনে বলি—নিশ্চয়ই মিয়ন্তিরা এনাকে ঘটকালি করতে বলেছেন। নইলে এরা সুজাতার কথা বলবে কেন? সুজাতা নাকি আমাকে পছন্দ করে—এই বলে একখানা ছবিও দেখায় তার। বাক্যটি আমাকে কিছুটা দুর্বল করে তোলে তার প্রতি। দেখতে খারাপ না। মিয়ন্তির সাথে মুখাবয়বের অনেকটাই মিল আছে। কমলার কোয়ার মতো লম্বা ও টসটসে। কিন্তু তবু আমি দ্বিধান্বিত। এক কথায় এ প্রস্তাবে ‘না’ বলা যাবে না কারণ তাতে মিয়ন্তিদের মন খুব খারাপ হবে। আর ‘না’ বলার পর আমিই-বা মুখ দেখাবো কী করে? এটা তো এক ধরণের আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব। আবার ‘হ্যাঁ’ বলারও সমস্যা আছে। আমি মিয়ন্তিদের জানি। কিন্তু সুজাতাকে তো জানি না। আমার সাথে যদি না মেলে! আমি শান্তিপ্রিয় মানুষ। যতটুকু বুঝি সংসারে দুটি মানুষ যদি পরস্পরকে না বোঝে কিংবা দুই মেরুর হয়, তবে সেখানে অশান্তি ও ভুল বোঝাবুঝির দরুন দাম্পত্য সংকট লেগেই থাকবে। কিন্তু ইনি নাছোড় হয়ে আমার কাছে তৎক্ষণাৎ একটা উত্তর আশা করেন। অগত্যা আমি বলে দেই—অপছন্দ হয়নি। তবে মিয়ন্তিদের জানাবেন—আমি ভেবে পরে জানাবো।

রাতে নিজের বাসায় বিয়ের ভাবনা আরও জেঁকে বসে। এটা সেটা যা-ই করি, এ ভাবনাটাই ভারি প্রলেপ মেখে যায় যেন। বাধ্য হয়ে আমাকে দেয়া সুজাতার ছবিখানা বার বার দেখি ও তার সম্পর্কে জানার চেষ্টা করি। কিছু উদ্ধার করি, বেশি কিছুই হেঁয়ালিপূর্ণ থেকে যায়।

সকাল দশটায় বাইরে বের হই। ছুটির দিন। একটু ভিন্নতার জন্য বাসে করে একা একা পুরো শহর ঘুরবো আজ। বাসে উঠে সিটে বসেও গেছি। এরই মধ্যে মিয়ন্তির স্বামী ফোন করে আমার অবস্থান জেনে নেন এবং এখনই তাদের বাসায় যেতে বলেন। আমি জানাই আমি এখন বাইরে একটা জায়গায় যাচ্ছি। বিকেলে কিংবা সন্ধ্যায় দেখা করবো আপনাদের সাথে। তিনি আমাকে জরুরী প্রয়োজনে এখনই যেতে বলেন। আর তাদের কোনো কথা যেহেতু কখনো ভেতর থেকে ফিরিয়ে দিতে পারিনি, তাই শুধু বলি—ঠিক আছে। আসছি। তাদের বাসায় যেতে যেতে আমাকে এত তাড়াহুড়া করে ডাকানোর একটা অর্থ উদ্ধার করি। এতে আমার বুকটা কেন জানি কেঁপে ওঠে। আবার কিছুটা ভালও লাগে। এ রকম মিশ্র অনুভূতি নিয়ে তাদের বাসায় পৌঁছাই।

ভেতরে ঢুকে তাদের মনোভাব দেখে মনে হয় ‘মেয়েকে আমার মনে ধরেছে’ জাতীয় চিন্তায় আচ্ছন্ন তারা। তাই মিয়ন্তির স্বামী আমাকে মেয়ের সাথে ভিডিও চ্যাট করিয়ে দেয় তেমন কোনো ভণিতা ছাড়াই।

এখন পিছে ফেরার আর অবকাশ নেই। হালকা সম্মতিতে বিয়ে নিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতে কীভাবে যেন আটকা পড়ে যাই। তাতে কী? বিয়ে তো করতেই হবে একদিন না একদিন।

সুজাতা দেশে থাকে। এ রকম মাধ্যম ছাড়া দেখা করিয়ে দেওয়া ছাড়া আর উপায়ই-বা কী? পাঁচ-দশ মিনিট মাত্র কথা হয়। স্থির চিত্রের চেয়ে এ মাধ্যমে আর একটু বেশি বাস্তবতার ছোঁয়া পাওয়া গেলো। চলনসই চেহারা, মাস্টার্স পাস, উচ্চকিত কণ্ঠের অধিকারিণী। এ মাধ্যমেই কথা হলো কয়েক সপ্তাহ।

যতটুকু কথা হয় তাতে চলে ছোটখাটো অনুযোগ—আমি তাকে গুরুত্ব দেই না কখনো; মনোযোগ দিয়ে তার কথা শুনি না; কথা বলা্র সময় এদিক-সেদিক তাকাই ইত্যাদি ইত্যাদি। ঠাণ্ডা মাথায় শুনে হেসে হেসে বোঝানোর চেষ্টা করি এর কারণ। কিন্তু সে যেন কিছুতেই কিছু বুঝতে চায় না। ওর অনুযোগ যে পুরোপুরি মিথ্যে তা নয়। আমি বুঝি সে একটু বেশি মনোযোগ প্রার্থী। তবে আমার ব্যক্তিত্বটাই ছিল অমন।

বায়বীয় মাধ্যমে কথা বলে যেটুকু বুঝেছি আমি যে চরিত্রের তার উল্টো সে। আমি যদি হই উত্তর মেরু, সে তবে দক্ষিণ মেরু। আমি যদি হই দিন, সে তবে রাত। ঠিক দিন-রাত্রির বাস্তব দূরত্বে থাকা দুজন।

এ রকম অমিল সত্ত্বেও আমার পক্ষে এ সম্পর্কের ইতি টানা সম্ভব হয়নি। এর কারণ সুজাতা তখন যতটুকু ছিল তার চেয়ে বেশি গুণে ছিল মিয়ন্তি পরিবার। মূলত এ পরিবারের মধ্য দিয়েই সুজাতা আমার মনে প্রোথিত হয়ে শাসন করতে থাকে। তবে ইতি টানার চেষ্টা যে করিনি তা নয়। অনেক ভেবেছি। নিজের সাথে যুদ্ধও করেছি। কিন্তু এত অমিল সত্ত্বেও আমার মনটা কেন জানি আটকা পড়ে যায় সুজাতার কাছে।

একদিন সুজাতা গভীর রাত পর্যন্ত জেগে থাকে। আমার এখানে তখন দুপুর। অনলাইনে আমাকে দেখে সে-ই প্রথম কল করে, যদিও আমি তখন আমার অন্যান্য সঙ্কটের পাশাপাশি তাকে নিয়েও ভাবছি। ভাবছি অর্থ যোগানের কথা। বিয়েতে দেশে গিয়ে যে অর্থ খরচ হবে তা এখন আমার কাছে নেই। কারও কাছে পাবো বলেও মনে হয় না। তাই কিছুটা সময় যাক না এভাবে। আরও ভাবছি নতুন জীবন কেমন হবে ইত্যাদি। টুকিটাকি কথা হয় দুজনায় এসব ভাবনার মধ্য দিয়ে। এক সময় সে নীরব হয়ে যায়। খেয়াল করি প্রতিদিনকার মতো আজকে ওড়নাটা সে পরেনি। তার চোখদুটো মদির নেশায় আমার দিকে তাকাতে থাকে যেন এ মুহূর্তে খুব করে কাছে চাইছে আমাকে। আমিও ভেতরে ভেতরে পাগল হয়ে যাই। কিন্তু সে যেভাবে তা প্রকাশ করতে পারছে আমি পারছি না। আমার সঙ্কটগুলো আমাকে গিলে খাচ্ছে। তখন জানালা দিয়ে বাইরে কিছুক্ষণ তাকাই। তাছাড়া আমি মনে মনে চাইনি পাকাপোক্ত কিছু একটা হওয়ার আগেই সে আমার জন্য পাগল হয়ে যাক। অর্থ সঙ্কট, ভাল চাকুরীর অভাব, স্পনসরশিপের জটিলতায় যদি কোনো কারণে বিয়েটা না হয়, তবে সে হয়তো ভেঙে পড়বে। এত ভেবে তার সকাতর, ব্যস্ত-ব্যাকুল অথচ থমথমে মৌনতায় আমি সাড়া দিতে পারি না তখন। আমার আপাত এই নিস্ক্রিয়, নিস্পৃহ মনোভাবকে সে যে কী বুঝে নেয় তা আজো বুঝিনি আমি।

আসলে ভুলটা আমারই। বেশি দ্রুত তার প্রেমে পড়ে গেছি আমি। আর এই ‘প্রেমে পড়া’ কথাটির মধ্যেই হয়তো প্রেমের পরিণতি নিহিত। মানে পতন, উত্থান নয়। অনুভূতির উত্থান ঘটে সত্যি, কিন্তু নিজের সমস্ত সত্ত্বার পতন ঘটে। আপনি পড়ে যাচেছন কোনো এক মায়াবী গহ্বরে, পড়ার সময় আনন্দ লাগছে। কিন্তু ওখান থেকে উত্থান বা উঠে আসা কঠিন যদি না এবং যতক্ষণ না সেই কাঙ্খিত ব্যক্তিটি আপনাকে তুলছে। তাই ভাবি কেনো যে ‘প্রেমে পড়া’ না হয়ে ‘প্রেমে ওঠা’ হলো না। তাহলে হয়তো কারো মুখাপেক্ষী হতে হতো না এবং প্রেমের সাথে সাথে অন্য সবও মিলতো।

আমার আপাত নিস্পৃহতাকে সুজাতা সেদিন হয়তো বুঝে নেয় প্রত্যাখ্যান হিসেবে। আর এটাকে সে তার নিজের ব্যক্তিত্বের উপর চরম আঘাত হিসেবেও ভেবে নেয়। এজন্য  একদিন খুব করে কেঁদেছে শুনেছি। অবশ্য অজুহাত দেখিয়েছে অন্য কিছুকে—আমি যখন খোঁজ নিয়ে জানলাম যে এখানে আসার পর পড়ালেখা ও থাকা-খাওয়া বাবদ সরকারের কাছ থেকে ধারকৃত টাকা পরিশোধ না করলে কাউকে আনার জন্য স্পনসর করা যায় না, তখন এ কথা মিয়ন্তিদের জানালে ভিডিও চ্যাটে থাকা সুজাতা কথাগুলো শোনে আর ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে। সেই সঙ্গে দোষও দেয় বোন-বোনাইকে এভাবে না জেনে বিয়ে ঠিক করার জন্য। সেই মুহূর্তে তার কান্না দেখে আমার ভেতরটা খুবই নরম হয়ে ওঠে। আমি আমার আর্থিক অসামর্থ্যের কথা ভুলে গিয়ে দেশে গিয়ে বিয়ে করবো বলে কথা দেই। যদিও এর আগে কথা ছিল সুজাতাকেই এখানে এনে বিয়ের ব্যবস্থা করা।

কেউ কেউ বড় ভালবেসে নিজের হৃদয়কে জমিন হিসেবে বিছিয়ে দেয়। তবে সেটা পায়ে দলিত হওয়ার জন্য নয়। সেই বিছানো জমিনে ভালবাসার হৃদয়খানি যাতে শান্তিতে ঘুমোতে পারে এবং তাকে ঘুম পারিয়ে দিতে পারে সে জন্য।

কিন্তু সুজাতা আমাকে ভুল বুঝে আমার হৃদয়-জমিনকে শুধু পদদলিতই করে গেছে। কখনো আর ফিরে তাকায়নি। কোনো ডাকেই আর বিশ্বাস করেনি। প্রথমেই যে খাদ দেখতে পায় সম্পর্কে, তার কাছ থেকে নিখাদ-নিপাট পরিণতি সুদূরের দুঃস্বপ্ন ছাড়া আর কিছু হয়তো নয়। আমি তো ভালবাসতে চাইনি এমন কাউকে। আমার সাথে যায় না এরকম রমণীদের কাছ থেকে আজীবন দূরে দূরে থেকেছি। বলতে গেলে কখনো কখনো পালিয়ে পালিয়ে বেড়িয়েছি। আমাকে ডেকে এনে ভালবাসিয়ে যেন হেঁচকা পিছুটান! তাছাড়া সুজাতা সেই সঙ্কটের রাতের পর দিন আমাকে ফোন করে বলে যে আমি যদি কোনো খবর দিতে পারি তবে যেন ফোন করি, আর তার দিক থেকে যদি কোনো খবর হয় সে জানাবে। এই পর্যন্তই। এই সঙ্কটের মুহূর্তে আলোচনা না করে কিংবা ফোনালাপ/স্কাইপালাপ না চালিয়ে সে পিছুটান দেয়। আমি ভেবে নেই যদি বিয়েটা না হয় সে জন্য হয়তো সে কষ্ট পাবে। আর এজন্য হয়তো কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছে। কিন্তু আমার এ ধারণা কখনো সঠিক ছিল না।

এরপর বেশ কয়েক দিন মিয়ন্তিদের সাথে কিংবা সুজাতার সাথে আর যোগাযোগ হয়নি। কিন্তু আমার মনে ছিল তার নিত্য আনাগোনা। ভাবনার প্রতিটি অলিগলি ধরে প্রতিটি ক্ষণ সে হাঁটতো, দৌড়াইতো, গড়গড়িয়ে বেড়াতো। অনেক ভেবে এবং চেষ্টা-চরিত্র করেও কোনোভাবেই আমার পক্ষে টাকা যোগাড় করা সম্ভব হয়নি। তাই কিছুদিন সময় চাই মিয়ন্তিদের কাছে। এতে তারা সম্ভবত ভেবেছে আমি পিছুটান দিয়েছি, বিশ্বাসঘাতকতা করেছি। মেয়ের অভিভাবক হিসেবে সে রকম চিন্তা করাই হয়তো স্বাভাবিক। কিন্তু তাদের সেই ভাবনা সংক্রামিত করে সুজাতাকেও। তাই হয়তো তাকে ফোন করলে সে মুখের উপর এমনভাবে উচ্চকিত কণ্ঠে ‘না’ বলে যে, তাতে নিমিষে আমার পায়ের রক্ত মাথায় এবং মাথার রক্ত পায়ে পরিভ্রমণ করে, মাথার তালু চরম গরম হয়ে যায়। এর প্রভাবে প্রায় দুদিন কিছুই খেতে পারিনি। তবুও সুজাতাকে ভেবে উত্তর করতে সময় দেই। সে দু’সপ্তাহ সময় নেয়। আমিও সময় দেই। কারণ আমি চাই সে আমাকে চিনে, বুঝে তবে ভালবাসুক এবং কাছে আসুক।

জানি তার সাথে আমার কিছুই মেলে না—চিন্তা-ভাবনা, পছন্দ-অপছন্দ, ব্যক্তিত্ব—কিছুই না। তারপরও তার প্রতি কেন যে এত দুর্বল হলাম? এত অযৌক্তিক আচরণ আমার পক্ষেও সম্ভব? যৌক্তিকভাবে চিন্তা করলে সে ফিরে না আসুক এটাই মনে হয়। কিন্তু আমার মানসিক অবস্থা দেখে চিন্তা করলে তবুও সে ফিরে আসুক—বারবার এটাই চাই। পরেরটাই আমার মধ্যে আধিপত্য বিস্তার করে। খুবই কষ্ট হয় আমার প্রতিনিয়ত। কোনোভাবেই মাথা থেকে সরাতে পারি না তার চিন্তা। কোনো কাজেও সেভাবে মন বসাতে পারি না।

কদিন নিজেকে খুব করে বুঝিয়েছি। এই স্বাভাবিক লাগে আবার পরের মুহূর্তে অস্থির লাগে। আমার হৃদয়ে বড় একটা ক্ষত রেখে গেলো সে। আমি জানি সবাই সবকিছু পায় না। সব কিছু সবার জন্য নয়। এই যে আলিশান বাড়িটা দেখা যাচ্ছে আমার বসার টেবিলের জানালা দিয়ে এটা তো আমার নয়। এমনকি যে দেহে আমি জন্মের পর থেকে আজ অবধি বাস করছি সে দেহখানিও তো আমার নয়, মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে তা অন্য কিছু হয়ে যাবে, অন্য কারো হবে। তাই বলে কি মন খারাপ করা চলে। আর সেখানে জগতের কোনো কিছুই আমার নয়। সেখানে আমার দেখার অধিকার আছে মাত্র, ছোঁয়ার বা ভালবেসে নিজের করার অধিকার নেই। এভাবেই নিজেকে প্রবোধ দিয়ে চলছি। কখনো কাজও দিচ্ছে, কখনো আবার দিচ্ছে না। মোট কথা দিনের শেষে বুকের চিনচিন ব্যথাটা থেকেই যাচ্ছে।

দু’সপ্তাহ শেষে আসে শেষের রাতটি। বারোটা বেজে পনের মিনিট। কাঁটায় কাঁটায় দু’সপ্তাহ সময় শেষে অনেক হিসেব কষে অবশেষে সে আমাকে প্রত্যাখ্যান করে কোনো প্রকার আপোস করতে পারবে না বলে। বেশ তবে তাই হোক। সুখে থাক সে। এই মুহূর্তে তো কত কী ঘটছে পৃথিবীর নানা প্রান্তে! সময়ও এহেক জায়গায় এহেক রকম। ঘটনাও এহেক রকম। কেউ হয়তো ঘুম থেকে উঠছে, কেউ ঘুমাতে যাচেছ, কেউ স্বপ্ন দেখছে, কেউ-বা রাস্তায় হাঁটছে, দৌড়াচেছ বা কাউকে তাড়া করছে নয়তো তাড়া খাচেছ। এই মুহূর্তে কোনো দম্পতি হয়তো মধুর আলিঙ্গনে পরস্পরকে জড়িয়ে মথিত করছে, কোনো দম্পতি অভিমানে মুখ ফিরিয়ে শুয়ে আছে, কোনো দম্পতি পরস্পর থেকে অনেক দূরে থাকায় আকুলভাবে কাছে কামনা করছে। এ মুহূর্তে কোনো কপোত-কপোতী নিজেদেরকে হারানোর জন্য উপযু্ক্ত জায়গা খুঁজছে মরিয়া হয়ে। এ মুহূর্তে কেউ হয়তো চুরি করছে, কেউ বোমাবাজি করছে, কেউ বা বিষোদগারে আরেকজনের চৌদ্দ গোষ্ঠী উদ্ধার করছে। কত বিচিত্র ঘটনাই না ঘটছে একই সময়ে, কিন্তু সময়ের বিভিন্ন অবয়বে বিভিন্ন জায়গায় এবং বিভিন্ন মাত্রায়। এ মুহূর্তে আমার রাত; বারোটা বাজা শুরু। আর সুজাতার সকাল; দশটা বাজা শুরু। আমার শুভ রাত্রি; আর সুজাতার শুভ সকাল। তবুও দুই শুরু দুই রকম; দুই শুভ দুই রকম।

শূন্যতায় ভর করে চলছি শুধু। বড় অসহায় ও নিরালম্ব লাগছে নিজেকে। আশ্রয় বলে কিছু নেই আর। মানসিক অস্থিরতা অনবরত কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে আমায় । একা বড় একা হয়ে পড়েছি। কোনো কিছু করেই শান্তি পাচ্ছি না। হায়রে জীবন আমার! প্রবাসের অসহায় ও নিঃসঙ্গ জীবনে কোথাকার কে কদিনের জন্য জীবনে এসে সব এলোমেলো করে দিলো।

শুরুতে সুজাতা আমাকে বেশি জানতো, আমি তাকে জানতাম কম। এখন মনে হয় আমি তাকে বেশি জানি। আমাকে চিনতে তাকে সময় দিয়েছিলাম। অথচ সে শুধু নিজেকেই চিনিয়ে গেলো। তাকে যতটা আমি পাঠ করেছি সে আমাকে ততটা পাঠ করতে পারলো না। তবুও সবার কাছে আমার হৃদয় ভেঙে বিশ্বাস করাতে হলো আমি কারও হৃদয় ভাঙ্গিনি!


Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*