ট্রু ট্রাশ – অনুবাদ

গল্প

ট্রু ট্রাশ

ট্রু ট্রাশ

মূল: মার্গারেট এটউড

অনুবাদ: সেলিম মিয়া


চামড়া ছাড়িয়ে নেওয়ার পর তেলে চকচক করে ওঠা গোলাপি-বাদামি রঙা এক ঝাঁক সিল মাছের মতো পরিচারিকারা রোদ পোহাচ্ছে। গোসলের পোশাক পরে আছে তারা। কারণ এখন বিকেলবেলা। খুব সকাল ও সন্ধ্যায় তারা অবশ্য মাঝে মাঝে কাপড় ছাড়াই সাঁতরে বেড়ায়। তাদের ছোট্ট ব্যক্তিগত ডক থেকে মশা-উপদ্রুত ঝোঁপে এতে করে চুলকানির হাত থেকে বেশ খানিকটা রক্ষা পায় তারা।

ডনির কাছে বাইনোকুলার আছে। সেটা অবশ্য তার না, মন্টির। মন্টির বাবা পাখি দেখার জন্য মন্টিকে দিয়েছিল। কিন্তু মন্টির সেদিকে আগ্রহ নেই। তার চেয়ে আরও সদ্ব্যবহারের উপায় সে খুঁজে পেয়েছে। সেটা হলো অন্য ছেলেদের ভাড়া দেওয়া। সর্বোচ্চ পাঁচ মিনিট ভাড়া দেয়। একবার দেখলে পাঁচ পয়সা অথবা খাবারের দোকান থেকে একটা চকোলেট পায়, যদিও সে টাকাটাই বেশি পছন্দ করে। তবে সে চকোলেট খায় না। সেগুলো দ্বিগুণ দামে পুনরায় বিক্রি করে। কালো বাজারি আর কী! কিন্তু দ্বীপটিতে বাইনোকুলারের সামগ্রিক সরবরাহ সীমিত থাকায় সে পার পেয়ে যেতে পারে।

ডনি ইতোমধ্যে যা দেখার দেখে নিয়েছে। কিন্তু তারপরও লাইনে যারা আছে তাদের কানাঘুঁষা ও বলাবলি সত্ত্বেও বাইনোকুলারটা সে রেখে দিয়েছে। সে যে তার টাকাটা উসুল করে নিতে চায়!

“ওদিকে একটু দেখো,” যেমনটা সে আশা করে তেমন প্রলুব্ধকর কণ্ঠে বলে। “লালা ঝরছে, লালা ঝরছে।“ ওর পেটের ঠিক তাজা মশা কামড় দেয়া জায়গটায় একটা লাঠি গুঁতা দিচ্ছে। কিন্তু বাইনোকুলার থেকে হাত সরিয়ে না নিলে সে লাঠিটা ঠেলতে পারছে না। এ রকম পার্শ্ব আক্রমণ সম্পর্কে ধারণা আছে তার।

রিচি ওর কনুই ধরে টান দিয়ে বলে, ‘দেখি, দেখি।‘

ডনি বলে, ‘দূর হ।‘ পিচ্ছিল নগ্ন কটিদেশ, লাল ফুটকিযুক্ত বুক ও ধোপ শাদা একটা লম্বা চুল দেখে সে বাইনোকুলারটি দিয়ে দেয় সবচেয়ে আবেদনময়ী, সবচেয়ে নিষিদ্ধ রনেটকে। শহুরে মেয়েদের সাথে মেলামেশা করার বিপদের ব্যাপারে শীতকালে যখন সেন্ট জুডের ধর্মগুরুরা ছবক দেন, তখন রনেটের মতো মেয়েদের কথাই তাদের মনে আসে। যে সব মেয়েরা শহরের একমাত্র সিনেমা-নাট্যশালায় লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে ছেলেবন্ধুদের লেদার জ্যাকেট পরে চুইম গাম চিবোতে থাকে। তাদের চিবোতে থাকা মুখগুলো ভর্তা হয়ে যাওয়া টকটকে লাল রাস্পবেরির মতো চকচক করে ওঠে। আপনি যদি তাদের দেখে শিস বাজান কিংবা তাকানও, তবে তারাও সোজা আপনার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকবে।

এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা ছাড়া রনেটের মধ্যে সব কিছু আছে। অন্যদের চেয়ে হাসির জন্য সে বিখ্যাত। তাকে টেবিলে পাওয়ার জন্য ডনি ও তার বন্ধুরা প্রতি দিন বাজি ধরে। থালাগুলো পরিস্কার করতে যখন সে সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ে, তখন তারা তার শান্ত কিন্তু ভি-আকৃতির গলাবিশিষ্ট পোশাকের সামনের দিকে তাকাতে চেষ্টা করে। তার দিকে আড় চোখে তাকায়, নিঃশ্বাসের সাথে ভেতরে নেয়। কারণ তার শরীর থেকে হেয়ার স্প্রে, নেইল পলিশের গন্ধ বেরোয়, যা কৃত্রিম এবং খুব বেশি মিষ্টিমধুর লাগে। ডনির মা বলতেন, সস্তা জিনিস। এ শব্দটা প্রলুব্ধকর। ডনির জীবনে বেশিরভাগ জিনিসই ব্যয়বহুল এবং খুব বেশি মজার না।

ডকে অবস্থান পরিবর্তন করে রনেট। চিবুকে হাত ঠেকিয়ে এখন সে উপুড় হয়ে শুয়ে আছে। এতে তার স্তনযুগল মাধ্যকর্ষণের ফলে নিচে ঝুলে পড়েছে। তারই আসল বক্ষবিভাজিকা রয়েছে। কিন্তু ডনি রনেটের পোশাকের ওপরে কলার-বোন ও বুকের কিছু পাঁজর দেখতে পায়। স্তন থাকা সত্ত্বেও রনেট চিকন, রোগাটে। তার বাহুদুটো ও চিবুক ছোট। যেন-বা মুখমণ্ডলে গুঁজে আছে। চাপার এক পাশে একটা দাঁত নেই। সে হাসলে সেটা চোখে পড়ে। আর এটাই ডনির বিরক্তির কারণ। ডনি জানে রনেটের জন্য তার কামনা জাগার কথা। কিন্তু জাগে না।

পরিচারিকারা জানে তাদের দিকে সবাই তাকিয়ে আছে। কারণ ঝোঁপগুলোকে এপাশ-ওপাশ নড়তে দেখছে তারা। ছেলেগুলো বারো কি তেরো, কিংবা বড় জোর চৌদ্দ বছর বয়সী ছোঁকড়া হবে। ছেলেগুলোর জায়গায় যদি কাউন্সেলর হত, তবে পরিচারিকারা আরও খিলখিল করে হাসত, নিজেদের আকর্ষণীয় করে তুলত, পিঠগুলো বাঁকাত। সবাই না হলেও কেউ কেউ তো করতই। যেমনটা হয়, তারা বিকেলের বিরতিতে এমনভাবে বেরোয় যেন কেউ নেই সেখানে। তারা একে অপরের পিঠে তেল মেখে দেয়, আগুন পোহায়, এদিক-সেদিক অলসভাবে ঘুরে তাকায় এবং রিচি, যার হাতে এখন বাইনোকুলারটা আছে, তাকে এমনভাবে চিৎকার করায় যে, তা অন্য ছেলেদের যেন পাগলের মতো করে তোলে। আর করেও তা-ই। ছোট-খাটো কিল-ঘুঁষি আদান-প্রদান হয়, ‘শালা’, ‘বাল’ মৃদুস্বরে উচ্চারিত হতে থাকে। ‘লালা ঝরছে, লালা ঝরছে,’ বলে রিচি অট্টহাসি দিয়ে কানাকানি শুরু করে।

পরিচারিকারা জোরে জোরে পড়ছে। পালাক্রমে পড়ছে। তাদের কণ্ঠস্বর পানির ওপারে ভেসে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে শুধু হাস্য-কলরোল ধ্বনিতে স্বরগুলো থেমে যাচ্ছে। ডনি জানতে চায় এমন গভীর মনোযোগের সাথে, এমন আগ্রহের সাথে তারা কী পড়ছে। কিন্তু সেটা স্বীকার করা তার জন্য বিপজ্জনক হবে। পরিচারিকাদের দেহই ব্যাপার। কী পড়ছে তাতে কী এসে যায়?

ডনি রিচিকে ফিসফিসিয়ে বলে, ‘তোমার সময় শেষ, মাতাল।‘

রিচি বলে, ‘তুমিই মাতাল।‘ ঝোঁপগুলো নড়ে-চড়ে ওঠে।

পরিচারিকারা যা পড়ছে তার নাম হলো ট্রু রোমান্স  ম্যাগাজিন। ট্রিশিয়ার কাছে ওগুলো অনেক আছে। তোষকের নিচে সে গচ্ছিত রেখেছে। আর স্যান্ডি ও প্যাট প্রত্যেকেই একটা করে দিয়েছে। প্রতিটা ম্যাগাজিনে একজন করে নারীর প্রচ্ছদচিত্র আছে। কোনও নারীর কাঁধের ওপর তার গায়ের পোশাক নামানো, কোনও নারীর মুখে সিগারেট আছে কিংবা এলোমেলো জীবনের অন্য কোনো নিদর্শন আছে। এ নারীগুলোর চোখ সাধারণত অশ্রুতে টলমল করে। তাদের রঙ অদ্ভূৎ হয়ে থাকে: উৎকট, ময়লা-প্রবিষ্ট, যেন-বা সস্তা দোকানে হাতের বর্ণপ্রলেপে মলিন হওয়া ছবি। দু’পায়ের মধ্যকার হাঁটুতেও রঙ। তবে প্রফুল্ল প্রাথমিক রঙগুলো তাদের মধ্যে নেই। নেই ছায়াছবির ম্যাগাজিনের পরিচ্ছন্ন দন্ত-হাসি। এগুলো অবশ্যই সাফল্যের কাহিনি নয়। হিলারি এগুলোকে বলে, প্রকৃত বর্জ্য (ট্রু ট্র্যাশ)। আর জোয়ান বলে, নাটকের বিলাপ।

ম্যাগাজিনটা এখন জোয়ান পড়ছে। রেডিওতে যেমন কেউ পড়ে, সে রকম গুরুগম্ভীর, আবেগাপ্লুত কণ্ঠে সে পড়ছে। স্কুলে থাকা অবস্থায় সে তো আওয়ার টাউন নাটক করত। শিক্ষকের মতো নাকের ডগায় সানগ্লাস বসিয়ে রাখত। বাড়তি আনন্দ-উল্লাসের জন্য মেকি টানে কথা বলত।

গল্পটা একটা মেয়েকে নিয়ে। মেয়েটা তার তালাকপ্রাপ্তা মায়ের সাথে জুতার দোকানের উপরে ঘিঞ্জিযুক্ত একটা অ্যাপার্টমেন্টে গাঁদাগাঁদি করে থাকত। মেয়েটার নাম মারলিন। স্কুলের পর এবং শনিবার করে সে দোকানটিতে খন্ডকালীন কাজ করত। আর দোকানের দুজন কেরানি তার পিছে পিছে ঘুরত। তাদের মধ্যে একজন ছিল নির্ভরযোগ্য ও বিরক্তিকর। সে চাইত মারলিন তাকে বিয়ে করুক। আরেক জন, যার নাম ডার্ক, সে মোটরসাইকেল চালাত এবং সবজান্তা গোছের প্রগলভ দন্ত-হাসি হাসত। এ হাসি দেখলে মারলিন নার্ভাস হয়ে যেত। মারলিনের ওয়ারড্রোব ও সেলাই মেশিনের কাজে তার মা ভৃত্যের মতো খাটতেন। ধনী মহিলারা, যারা তাকে দেখে বিদ্রুপ করতেন, তাদের জন্য কাপড় বানিয়ে কোনও রকমে জীবন ধারণ করতেন। সে কারণে ওয়ারড্রোবটা সব সময় ঠিক রাখতেন। আর মারলিন যেন সঠিক মানুষ খুঁজে নেয় সে ব্যাপারে তার সাথে খ্যাঁচ খ্যাঁচ  করতেন। তিনি যে গুরুতর ভুল করেছিলেন সেই একই ভুল যেন না করে বসে সে। মেয়েটা নিজে বাণিজ্য স্কুলে হসপিটাল ম্যানেজমেন্ট পড়তে গেছে। কিন্তু টাকার অভাবে পড়াটা অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে।  হাই স্কুলের শেষ বর্ষে এখন সে। আর তার গ্রেড নিচে নামছিল। কারণ উৎসাহ হারিয়ে ফেলেছিল এবং দুজন কেরানির মধ্যে কাকে বেছে নেবে সে ব্যাপারেও সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছিল। গ্রেড যে নিচে নামছিল সেটা নিয়ে মা-ও কথা শোনানো শুরু করেছিলেন।

হিলারি বলে, ‘হায় ঈশ্বর’। এমারি বোর্ডের বদলে সে ধাতব ফাইল দিয়ে তার নখ মসৃণ করছে। এমারি বোর্ড তার ভালো লাগে না। ‘কেউ একজন দয়া করে তাকে ডাবল স্কচ দিয়ে যাও।‘

স্যান্ডি বলে, ‘মাকে খুন করে বীমার টাকাটা তুলে এ নরক থেকে হয়ত ওর বের হওয়া উচিৎ।‘

চশমার উপর দিয়ে চোখ তুলে জোয়ান বলে, ‘বীমা সম্পর্কে একটা কথাও শুনেছিস নাকি?’

প্যাট বলে, ‘তুই কিছু রাখতে পারতিস।‘

লিজ বেহায়ার মতো বলে, ‘ওর হয়ত দুটোই চেষ্টা করে দেখা উচিৎ যে, কোনটা সব চেয়ে ভালো।‘

ট্রিশিয়া বলে, ‘কোনটা সব চেয়ে ভালো সে তো আমরা জানিই। শোন, ডার্কের মতো নাম আছে যার তাকে তুই কীভাবে বাদ দিস?’

স্টিফ্যানি বলে, ‘ওদের দুজনকেই আমার অসহ্য।‘

জোয়ান বলে, ‘ওটা করলে ও বড় ধরণের পতিত নারী হবে। পরে খুব প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে।‘


২য় পর্ব

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*