ভাষার ক্ষমতা

ভাষার ক্ষমতা

ভাষার ক্ষমতা

-সেলিম মিয়া


জীবনের নানা ধরণের বিষয়েই থাকে ভাষা। ভাষা মায়ের মতো, যেহেতু এতদিনের বলা ভাষার জগতে তা প্রতিটা ধ্যান-ধারণা, প্রতিটা অনুভব-অনুভূতি, প্রতিটা ইতিহাস, প্রতিটা গল্পকে ধারণ করে। প্রগতি কিংবা অপ্রগতির বিবরণ, ঘটনা বা দুর্ঘটনার বিবরণ এত সুন্দরভাবে এবং বিশদভাবে বর্ণনা করা থাকে এই ভাষায় যা প্রকাশের অন্য কোনো মাধ্যমে সম্ভব না। ভাষায় ব্যবহৃত প্রতিটা শব্দে থাকে কোনো না কোনো চিহ্ন, ছাপ, যে ছাপ বা চিহ্ন থাকে ভাষাটা যেভাবে, যে স্বাদে, যে মনোভঙ্গিতে ব্যবহার হয় সেই ইঙ্গিতে।

তবে এমন ভাষা জানাই যথেষ্ট না। বিভিন্ন বিষয়কে ভাষায় প্রকাশ করতে হলে এর সাংস্কৃতিক ভাষাটাও জানতে হবে। একে ছাড়া সবকিছু বোঝা যায় না। এ বিষয়টা বিশেষ করে সত্য দ্বিতীয় ভাষা শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে।

বিভিন্ন অঞ্চলে বিশেষ করে দেশে বলা ভাষার অনন্যতা অথবা স্বাতন্ত্র্য ঘটায় নৈরাজ্য, বিশৃঙ্খলা ও অনিয়ম। আর কালের প্রবাহে তা নিজের নিয়ম ও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করে। এই পর্যায়ে একই ভাষা ভিন্ন ভিন্ন সৌন্দর্য সৃষ্টি করে, ঠিক যেমন একই গাছের ফুল বিভিন্ন মাটিতে ফোটে।

উপভাষা হোক, আঞ্চলিক ভাষা হোক কিংবা প্রমিত ভাষা হোক—প্রত্যেক ভাষারই নিজস্ব ক্ষমতা থাকে। কেবল প্রতিভাবান লেখক বা বক্তারাই তাদের লেখায় কিংবা বক্তৃতায় ভাষিক ক্ষমতার সৌন্দর্যকে সনাক্ত করে চিত্রায়ন করতে পারে। তাঁরা ভাষার স্বতন্ত্র দিকগুলো আয়ত্ত্ব করে সেই ভাষার প্রকরণে সৌন্দর্য সৃষ্টি করতে সক্ষম। যেমন—জাগো বাহে কোনটে সবাই প্রকাশভঙ্গিটা বাংলাদেশের রংপরু অঞ্চলের উপভাষিক অভিব্যক্তি। কিন্তু এর পূর্ণ বিকশিত সৌন্দর্য এতে রয়েছে। তারপর এই উপভাষিক অভিব্যক্তিটি এর নিজস্ব পরম ক্ষমতায় মূল ধারার বাংলা ভাষায় স্থান লাভ করে।

বলা হয়ে থাকে যে, যে কোনো ভাষাই হাতিয়ার। আর যেহেতু তা হাতিয়ার, তাই তাকে ইতিবাচক ও নেতিবাচক দুইভাবেই ব্যবহার করা যায়, বাঁচাতে ও মারতে ব্যবহার করা যায়, কাউকে কাঁদাতে ও হাসাতে ব্যবহার করা যায়, ধনী করতে ও গরীব করতে ব্যবহার করা যায়। ইতিবাচক ব্যবহার করা হয় জাতির উপকারার্থে। অন্যদিকে নেতিবাচক ব্যবহার হয় কায়েমি স্বার্থ সিদ্ধির জন্য।

ভাষা আমাদের অনুপ্রাণিত করে, উচ্ছ্বসিত করে, এবং বোঝায়। কেউ যখন ভাষার শাণিত শক্তি ব্যবহার করে তার বক্তৃতা প্রদান করে, তখন তা আমাদের অনুপ্রাণিত করে। কেউ যখন ভাষা ব্যবহার করে আমাদের গালমন্দ করে, তখন তাতে আমরা রেগে যাই। তাই যে কোনো শক্তির মতোই ভাষাকে ইতিবাচক ও নেতিবাচকভাবে ব্যবহার করা যায়। তবে এ কথা বলাই যায় যে, জগতের যে কোনো ক্ষমতার চেয়ে ভাষা সম্ভবত সবচেয়ে শক্তিশালী। অবশ্য সৌন্দর্য-ক্ষমতার পরে। যদিও ভাষার ক্ষমতা কখনো কখনো সৌন্দর্য-ক্ষমতাকেও ছাড়িয়ে যায়, যেমন ধরুন প্রথম দর্শনের সৌন্দর্য।

তবে ভাষার এই যে বিপুল ক্ষমতা তারও কিন্তু সীমাবদ্ধতা রয়েছে। কারণ যে ভাষা ব্যবহার করে কেউ ক্ষমতা প্রদর্শন করে তা কেবল সেই ভাষা-ভাষী মানুষের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। যতই শক্তিশালী হোক না কেন তা তার চৌহদ্দি অতিক্রম করতে পারে না। সেই ক্ষমতা জানতে হলে আরেক জনকে সেই ভাষায় প্রবেশ করে ভাষাটি আয়ত্ত্ব করতে হবে। এখানে এটা বলাই জ্ঞানীর কাজ যে, কোনো কিছুই ক্ষমতাহীন না বা কেউ ক্ষমতা ছাড়া না। এমনকি মৃত শব্দ বা ব্যক্তিদেরও তাদের নিজস্ব সুপ্ত ক্ষমতা থাকে।

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*