আইসিস ইন ডার্কনেস – অনুবাদ

আইসিস ইন ডার্কনেস

আইসিস ইন ডার্কনেস

মূল: মার্গারেট এটউড

অনুবাদ: সেলিম মিয়া


সেলিনাকে বিয়ে করতে চায়নি রিচার্ড। তার সাথে বিয়ের কথা কল্পনাও করতে পারেনি। বিরক্তিকর, একঘেয়ে, সুখকর গার্হস্থ্য দৃশ্যের মধ্যে তাকে রাখতে পারেনি। স্বামীর কাপড়-চোপড় ধোয়া-কাচা, খাবার-দাবার রান্না করা, চা ঢালা ইত্যাদি। সে যা চেয়েছিল তা ছিল একটা মাস, একটা সপ্তাহ,  এমনকি একটা রাত। মোটর রূমে না, গাড়ির পিছনে না। তার হাতড়ানো যৌবনের উচ্ছিষ্ট এসব জরাজীর্ণ জায়গাতে তার চলত না। অন্য কোথাও হতে হবে, যেখানে অন্ধকার ও অন্তহীনভাবে আরও অদ্ভূৎ। আইডা এর শেষ অঙ্কের মতো হায়ারোগ্লিফিক্সসহ একটা ভূগর্ভস্থ কক্ষের কথা কল্পনা করেছিল সে। একই নৈরাশ্য, একই উল্লাস-উত্তেজনা, একই ধ্বংসযজ্ঞ। এমন অভিজ্ঞতা থেকে আপনার পুনর্জন্ম হবে, অথবা মোটেও হবে না।

একে কামনা বলা যেত না। কামনা সেটাই, মেরিলিন মনরোকে দেখলে আপনার যেটা জাগে। কিংবা ভিক্টরি বার্লেস্কে স্ট্রিপারদের জন্য যেটা জাগে। (ভিক্টরি বার্লেস্ক নিয়ে সেলিনার একটা কবিতা ছিল। তার কাছে স্ট্রিপাররা ঝাঁকি দেওয়া, টোল পড়া এক ঝাঁক মোটা বারবণিতা ছিল না। তারা ছিল মসলিনের মতো স্বচ্ছ কাপড় পরা। তারা ছিল আলোর গুটি থেকে বের হয়ে আসা পরাবাস্তব প্রজাপতি। তারা ছিল চমৎকার।)

রিচার্ড যার জন্য লালায়িত ছিল তা সেলিনার শরীর ছিল না। সে চেয়েছিল সেলিনা তার রূপান্তর সাধন করুক। সে যা ছিল না তাতে রূপান্তর সাধন করুক।

তখন গ্রীষ্মকাল ছিল। বিশ্ববিদ্যালয় ও কফি হাউজ দুটোই বন্ধ ছিল। বৃষ্টির দিনগুলোতে রিচার্ড তার ভেজাটে, দম বন্ধ হওয়া ঘরের উঁচু-নিচু বিছানায় শুয়ে থাকত। শুয়ে শুয়ে বজ্রপাতের ধ্বনি শুনত। রৌদ্রময় আর্দ্র দিনগুলোতে সে এক গাছ থেকে আরেক গাছের ছায়ায় গিয়ে থাকত। লাইব্রেরি এড়িয়ে চলত সে। ম্যারি জোয়ের সাথে যৌনতার কাছাকাছি গদগদ ভাব হত এক বেলা। ম্যারি জো তার ভেজা চুমু ও নার্সের মতো পরশ দিয়ে রিচার্ডের শরীর বুলিয়ে দিত। আর বিশেষ করে ম্যারি জো যেভাবে চূড়ান্ত কিছুতে সচেতনভাবে আচমকা থেমে যেত, তাতে রিচার্ড স্থায়ীভাবে অসাড় হয়ে যেত।

ম্যারি জো বলত, ‘তুমি চাইবে না আমার পেটে বাচ্চা আসুক।‘ সে ঠিকই বলত। রিচার্ড তা চায়নি। যে মেয়ে বইয়ের মধ্যে কাজ করত, সে মেয়ে শ্বাসরুদ্ধকরভাবে গদ্যময়। তবে তখন সে ক্যাটালগিংটা ভালো পারত।

রিচার্ড জানত যে, ম্যারি জো স্বাভাবিক দৃষ্টিভঙ্গির সুস্থ মেয়ে ছিল। তার জন্য সে ভালোই হত। এমনই ছিল তার মায়ের অভিমত। রোববারের নৈশভোজনে যখন সে তাকে তাদের বাসায় একবার নিয়ে যাওয়ার মতো ভুল করেছিল, তখন তার মা এমন মত প্রদান করেছিল। ম্যারি জো ছিল ক্যানজাত গোমাংস, কটেজ পনির, কড-কলিজার তেল। সে ছিল দুধের মতো।

একদিন এক বোতল ইতালিয়ান লাল মদ কিনে রিচার্ড ফেরি করে ওয়ার্ডস দ্বীপে পার হয়ে গিয়েছিল। সে জানত যে, সেলিনা সেখানটায় থাকে। অন্ততপক্ষে কবিতাগুলোতে তা-ই ছিল।

সে জানত না সে কী করতে চায়। সেলিনাকে দেখতে চেয়েছিল, তার নাগাল পেতে চেয়েছিল, তার সাথে বিছানায় যেতে চেয়েছিল। জানত না প্রথম পদক্ষেপ থেকে শেষ পদক্ষেপ পর্যন্ত কীভাবে তাকে পাবে। কী হবে সে ব্যাপারে সে পরোয়া করত না। সে চেয়েছিল।

ফেরি পার হয়ে সে দ্বীপটির ছোট ছোট রাস্তা দিয়ে হাঁটছিল। এ দ্বীপে সে আগে কখনও আসেনি। ওখানকার বাড়িগুলো ছিল গ্রীষ্মকালীন বাড়ি। সস্তা, নগন্য, সাদা তক্তা কিংবা প্যাস্টেল দিয়ে তৈরি। কিংবা পাশগুলো ইনসুলব্রিক দিয়ে তৈরি। কোনও গাড়ি ঢোকার অনুমতি ছিল না। বাচ্চারা বাইসাইকেল চালাচ্ছিল, খাটো ও মোটা মহিলারা সাঁতারের পোশাকে তাদের চত্বরে রৌদ্র-স্নান করছিল। বহনযোগ্য রেডিও বাজছিল। রিচার্ডের মনে সেলিনার আবহ সম্পর্কে যা ছিল তা নয় এসব। সেলিনা কোথায় থাকে তা কেউ একজনকে জিজ্ঞেস করার কথা চিন্তা করেছিল সে। তারা জানবে সে এখানে দাঁড়িয়ে থাকবে। কিন্তু নিজের উপস্থিতি ঘোষণা দিতে চাইলো না রিচার্ড। পরের ফেরিটা ধরে সে ফিরে যাওয়ার কথা মাথায় এনেছিল।

তখন একটা রাস্তার শেষ প্রান্তে এক মিনিট দূরত্বে সে এক-তলার একটা কুটির দেখেছিল। কুটিরটি দুটো বিশাল উইলো গাছের ছায়ার মধ্যে ছিল। কবিতাগুলোতে উইলোর কথা ছিল। চেষ্টা তো করতে পারে সে।

দরজাটি খোলাই ছিল। বাড়িটা সেলিনারই ছিল, কারণ সে-ই ভেতরে ছিল। রিচার্ডকে দেখে সেলিনা একটুও বিস্মিত হয়নি।

সেলিনা বলেছিল, ‘আমি তো কিছু চীনাবাদাম-মাখনের স্যান্ডউইচ বানাচ্ছি যাতে করে বনভোজন হয়। ঢিলেঢালা কালো সূতির ট্রাউজার পরে ছিল সে। ট্রাউজারের রঙের আভা ছিল প্রাচ্যের, আর ওপরে পরে ছিল হাতাবিহীন কালো কাপড়। বাহুদটো ছিল সাদা ও চিকন। পাদুটোতে স্যান্ডেল পরা ছিল। রিচার্ড তার পায়ের লম্বা আঙুলগুলোর দিকে তাকিয়েছিল। পায়ের নখগুলো পিচ ফলের মতো হালকা গোলাপি রঙে রঞ্জিত ছিল। একটা বিষয় লক্ষ্য করে রিচার্ডের হৃদয়টা মোচড় দিয়ে উঠেছিল যে, নেই পলিশটা ছিল কাটা কাটা।

বোকার মতো রিচার্ড বলেছিল, ‘চীনাবাদামের মাখন?’ সেলিনা এমনভাবে কথা বলছিল যেন সে রিচার্ডকে প্রত্যাশা করছিল।

সেলিনা বলেছিল, ‘আর স্ট্রবেরির আচার। তোমার যদি আচার পছন্দ না হয়।‘ তখনও সেই সৌজন্যমূলক দূরত্ব।

রিচার্ড তার মদের বোতলটি দিতে প্রস্তাব করেছিল। সেলিনা বলেছিল, ‘ধন্যবাদ, কিন্তু তোমার নিজেরই তো পুরোটা পান করতে হবে।‘

রিচার্ড বলেছিল, ‘কেন?’ সে চেয়েছিল এটা ভিন্ন খাতে যাক। এক ধরণের স্বীকৃতি। নিঃশব্দ এক আলিঙ্গন।

সেলিনা তাকে গম্ভীরভাবে বলেছিল, ‘আমি পান করা শুরু করলে কখনই থামতাম না। বাবা মদে আসক্ত ছিলেন। এজন্যই তিনি অন্য কোথাও আছেন।‘

সেলিনার কবিতার আকর্ষণীয় পরোক্ষ-উল্লেখ করার মতো আশা নিয়ে রিচার্ড বলেছিল, ‘পাতালে?’

সেলিনা ঘাড় নেড়ে বলেছিল, ‘অথবা যা-ই হোক।‘ নিজেকে রিচার্ডের বোকার মতো লেগেছিল। রান্নাঘরের ছোট টেবিলটিতে সেলিনা চীনাবাদামের মাখন মাখতে ফিরে গিয়েছিল। আলাপ চালিয়ে যাওয়ার আর কিছু না পেয়ে রিচার্ড চারপাশে একবার তাকিয়েছিল। কেবল একটি রূম ছিল। থেকে থেকে আসবাবপত্র দিয়ে সজ্জিত ছিল। রূমটি ধর্মালয়ের মতো ছিল প্রায়। কিংবা তার ধারণায় অন্তত। এক কোণায় ছিল পুরান কালো টাইপরাইটারসহ একটি টেবিল ও বুকসেল্ফ। সেল্ফটি বোর্ড ও ইট দিয়ে তৈরি ছিল। বিছানাটি ছিল সংকীর্ণ ও উজ্জ্বল বেগুনি ভারতীয় সূতির চাদরে ঢাকা। এটাকে সোফা হিসেবেও ব্যবহার করা যেত। ছোট্ট একটা সিঙ্ক ছিল। ছিল ছোট্ট একটা চুলা। একটা ইজি চেয়ার, স্যালিয়্যান বিষয়। ভাঁজ পড়া বিবর্ণ একটা কার্পেট ছিল। তবে দেয়ালে কোনও ছবি ছিল না।

সেলিনা বলেছিল, ‘আমার ওসবের দরকার নেই।‘ স্যান্ডউইচগুলোকে ভাঁজ পড়া কাগজের ব্যাগে রেখে রিচার্ডকে সে হাত নেড়ে বাইরে যেতে ঈশারা করেছিল।

পাথরের তৈরি দেয়ালের নিচে একটা জলাশয় দেখা যাচ্ছিল। সেই দেয়ালে রিচার্ডকে নিয়ে গিয়ে তারা দুজনেই বসে বসে স্যান্ডউইচ খেয়েছিল। দুধের বোতলে সেলিনার কাছে কিছু লেমোনাড ছিল। তারা দুজনেই এটা নিয়ে হাত চালাচালি করেছিল। যেন একটা প্রথা, যেন একটা যোগাযোগ। সেলিনা তাকে অংশগ্রহণ করত দিচ্ছিল। সানগ্লাস পরে সেলিনা পা আড়াআড়ি করে বসেছিল। ক্যানো নৌকা করে দুজন লোক পাশ দিয়ে চলে গিয়েছিল। জলাশয়টিতে ঢেউ খেলে গিয়ে আলোর ঝলকানিগুলো দূর হয়েছিল। রিচার্ডের অদ্ভূৎ লেগেছিল। খুশিও লেগেছিল।

কিছুক্ষণ পর সেলিনা রিচার্ডকে বলেছিল, ‘প্রেমিক-প্রেমিকা হতে পারব না আমরা।‘ হাতের আঙুলের আচার চাটছিল সে। ঝাঁকি দিয়ে জেগে উঠেছিল রিচার্ড। এত আকস্মিকভাবে কেউ কখনও বোঝেনি আগে। যেন একটা চাতুরি, যা তাকে অস্বস্তিতে ফেলেছিল।

সেলিনা যে বিষয়ে কথা বলছিল তা না জানার ভাব দেখাতে পারত সে। তা না করে বলেছিল, ‘কেন নয়?’

সেলিনা বলেছিল, ‘তুমি নিঃশেষ হয়ে যাবে। তখন পরে তোমাকে আর পাওয়া যাবে না।‘

এটাই রিচার্ড চেয়েছিল: নিঃশেষ হয়ে যাওয়া। দৈবাগ্নিতে পুড়ে যাওয়া। একই সাথে সে উপলব্ধি করেছিল যে, এ নারীর জন্য, এ মেয়ের জন্য যে কিনা চিকন চিকন হাত ও ছোট ছোট স্তনসহ পাদুটো নয় বছর বয়সী বালিকার মতো করে ঝুলিয়ে রেখে তার পাশে দেয়ালটিতে বসেছিল, তার জন্য প্রকৃত যৌনাকাঙ্খা তার জাগত না।

রিচার্ড বলেছিল, ‘পরে?’ সেলিনা কি তাকে বলছিল, সে এত ভালো যে তার অপচয় ঘটানো যায় না? এটা কি এক ধরণের প্রশংসা ছিল? নাকি না?

সেলিনা বলেছিল, ‘যখন তোমাকে আমার প্রয়োজন হবে, তখন তোমাকে ফেরির দিকে হাঁটতে নিয়ে যাব।‘ কাগজের ব্যাগের মধ্যে স্যান্ডউইচ পুরে দিচ্ছিল সে।

রিচার্ডের জন্য ভালো কোনও উপায় খোঁজা হয়েছিল।গোপনে নজরও রাখা হয়েছিল। সে হয়ত খোলা বই ছিল। ছিল বোকাও। কিন্তু সেলিনার তা বার বার মনে করিয়ে দিতে হয়নি। তারা যখন হাঁটছিল, রিচার্ডের তখন রাগ লাগছিল। দোকানের ব্যাগে থাকা মদের বোতলটা তখনও আঁকড়ে ধরেছিল সে।

ফেরির ডকে রিচার্ডের হাত ধরেছিল সেলিনা। ধরে আনুষ্ঠানিকভাবে মর্দন করেছিল। সেলিনা বলেছিল, ‘আসার জন্য তোমাকে ধন্যবাদ।‘ তারপর সানগ্লাসটি চুলের ওপরে তুলে নিজের নীল-সবুজ চোখ দিয়ে তার দিকে কড়া দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল। দয়ালু হয়ে ও বিষন্নতার সাথে বলেছিল, ‘আলোটা শুধু কিছুক্ষণের জন্য জ্বলে, সব সময়ের জন্য নয়। বাকি সময়টায় তুমি একা।‘

তবে একদিনের জন্য যথেষ্ট চতুর ও জ্ঞানবানের মতো কথা আওড়েছিল রিচার্ড। ফেরিতে মনে মনে বলেছিল, নাটকের নটি।


২য় পর্ব                                                                                                            ৪র্থ পর্ব

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*