ওয়াইল্ডারনেস টিপস – অনুবাদ

গল্প

ওয়াইল্ডারনেস টিপস

ওয়াইল্ডারনেস টিপস

মূল: মার্গারেট এটউড

অনুবাদ: সেলিম মিয়া


বাবার জোরাজুরিতে রোলান্ড সেট থেকে বাদ পড়ে গিয়েছিল। প্রুর মতে রোলান্ড এতে সব সময় রেগে থাকত। জিহ্বাটা প্রুর নাভির চারপাশে ঘুরিয়ে জর্জ জিজ্ঞেস করেছিল, ‘তুমি কীভাবে বলতে পার?’ প্রু তখন জর্জের অফিসে চাইনিজ কার্পেটের ওপর অর্ধ-কাপড়ে শুয়ে সিগারেট খাচ্ছিল। তার চারপাশে ছিল প্রারম্ভিক হাতাহাতির সময় টেবিল থেকে ফেলে দেওয়া দিস্তায় দিস্তায় কাগজ। প্রু নিশ্চিত করেছিল যে, দরজাটা তালাবদ্ধ ছিল না। অনুপ্রবেশের ঝুঁকি নিতে পছন্দ করেছিল সে, বিশেষত জর্জের সেক্রেটারি কর্তৃক। প্রু তাকে প্রতিযোগী হিসেবে সন্দেহ করেছিল। কোন সেক্রেটারি এবং কোন সময়ের ঘটনা? পড়ে থাকা কাগজগুলো ছিল অ্যাডাম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা। প্রুর সাথে এভাবেই বিভিন্ন পর্বের যোগসাধন করে জর্জ। যেমন—সে সময়ে অন্য যে কুকর্মে লিপ্ত ছিল তা স্মরণ করে। জর্জ দ্রুত আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হয়েছিল। যতটা ভেবেছিল সে তার চেয়ে অনেক বেশি সহজ ছিল। যেন প্রদীপের আলোয় বর্শা দিয়ে মাছ ধরা। এসব লোক ছিল শিথিল ও বিশ্বাসযোগ্য। নিজেদের অসহিষ্ণুতার ইঙ্গিতে অথবা আগন্তুকদের প্রতি আতিথেয়তার অভাবে সহজেই বিব্রত হত। তারা জর্জের জন্য প্রস্তুত ছিল না। হাওয়াইয়ানদের মাঝে মিশনারি হিসেবে জর্জ খুশি ছিল। বিরোধের ইঙ্গিত পেলেই সে তার কথা বলার টান ভারি করে কমিউনিস্ট নৃশংসতাকে অন্ধভাবে উল্লেখ করত। নৈতিকতার উচ্চাসনে বসুন আগে, তারপর যা পেতে পারেন তা নিন।

প্রথম সেই নৈশভোজনের পর হাতে কফি কাপ নিয়ে তারা সবাই ড্রয়িং রুমে গিয়েছিল। সেখানে কেরোসিন বাতিও ছিল—গোলকের ছায়াসহ পুরান। জর্জকে হাতে ধরে প্রু বইয়ের আলমারির দিকে নিয়ে গিয়েছিল। আলমারিটার ওপর ছিল মেয়েগুলোর ছোটবেলার ক্ল্যামশেল ও পানিবাহিত কাঠ দিয়ে তৈরী। প্রু বলেছিল, ‘এই যে এটা। পড়ে পড়ে কাঁদো।‘ বলে কফি ভরাতে গিয়েছিল সে। জর্জ বইটি খুলেছিল। বইটি পুরান সংস্করণ। সে যেমনটি আশা করেছিল বইটির তেমনই প্রচ্ছদ পাতার পরের পাতায় ক্রদ্ধ দৃষ্টির কুঠার ও পেইন্টসহ এক যোদ্ধার ছবি ছিল। তারপর তাকগুলো তন্ন তন্ন করে খুঁজেছিল সে। ফ্রম সী টু সী। ওয়াইল্ড এনিমেলস আই হ্যাভ নৌন। দ্য কালেক্টেড পোয়েমস অব রবার্ট সার্ভিস। আওয়ার এম্পায়ায় স্টোরি। ওয়াল্ডারনেস টিপস।

‘ওয়াল্ডারনেস টিপস’ তাকে হতবুদ্ধি করে দিয়েছিল। ‘ওয়াল্ডারনেস’ মানে সে জানত, কিন্তু ‘টিপস’ কী?

শব্দটি বিশেষ্য নাকি ক্রিয়া এ ব্যাপারে সে তাৎক্ষণিকভাবে নিশ্চিত ছিল না। খাদ্যতালিকা থেকে সে যেমনটা জেনেছিল যে, অ্যাসপারাগাস টিপ আছে। সেই বিকেলে চামড়ার তলাবিশিষ্ট শহুরে জুতা পরে যখন সে ক্যানোতে চড়ছিল, তখন প্রুর কথায় আরও জেনেছিল, ‘বী কেয়ারফুল, ইট টিপস।‘  এই ‘টিপস’ সম্ভবত অন্য ধরণের টিপস, যেমনটা নারীদের ম্যাগাজিনে ‘হ্যান্ডি টিপস ফর হ্যাপি হোমমেকারস’ কলামে তার নিজের ইংরেজির উন্নতি সাধন করতে সে সাগ্রহে পড়েছিল। এখানকার শব্দগুলো ছিল মোটামুটি সোজা এবং সাথে ছবি ছিল। এটা তাকে শিখতে অনেক সাহায্য করেছিল।

বইটি খুললে সে দেখেছিল যে, তার অনুমানই ঠিক। ‘ওয়াল্ডারনেস টিপস প্রকাশিত হয়েছিল ১৯০৫ সালে।  মোটা কাপড়ের পশমি জ্যাকেট ও পশমি হ্যাট পরিহিত লেখকের ছবি ছিল। মুখে ছিল পাইপ। জানালা দিয়ে আপনি কম-বেশি যা দেখতে পারবেন, যেমন—পানি, দ্বীপপুঞ্জ, শিলা, গাছ-গাছালি তেমন পটভূমিতে লেখক ক্যানো চালাচ্ছিলেন। বইটিতে বলা হয়েছিল আপনি কীভাবে উপকারী জিনিস সম্পাদন করবেন, যেমন—ছোট ছোট প্রাণীকে ফাঁদ পেতে ধরে খেয়ে ফেলা। এ জিনিসটা জর্জ নিজেই করেছিল, যদিও বনের মধ্যে নয় কিংবা ঝড়ো বৃষ্টিতে আগুন জ্বালিয়ে নয়। স্বাধীনতা ও মুক্ত বাতাসের আনন্দ এবং মাছ ধরা ও সূর্যাস্তের বর্ণনা নিয়ে এসব নির্দেশ গীতল প্যাসেজসহ ছড়ানো-ছিটানো ছিল। বইটি হাতে নিয়ে জর্জ একটা গোলক বাতির কাছের চেয়ারে বসেছিল। চেয়েছিল ছুরির চামড়া ছাড়ানো সম্পর্কে পড়তে। কিন্তু প্রু কফি নিয়ে ফিরে এসেছিল। আর পোর্শিয়া তাকে চকোলেট দিতে চেয়েছিল। আর জর্জ চায়নি তাদের কাউকেই অসন্তুষ্ট করার ঝুঁকি নিতে, শুরুর এই পর্যায়ে নয়। সেটা তো পরেও হতে পারে।

এখন জর্জ আবার এক কাপ কফি হাতে নিয়ে আবার ড্রয়িং রুমে হেঁটে যায়। এ সময়ের মধ্যে প্রপিতামহের সংগ্রহে থাকা সব বই পড়ে শেষ করে সে। একমাত্র সে-ই শেষ করে।

তার পিছু নিয়ে প্রু ভেতরে চলে আসে। মেয়েগুলি পালাক্রমে থালা-বাসন সাফ করে। প্রুর পালা নয় এখন। রোলান্ডের কাজ হচ্ছে কাঠ চেরা। জর্জকে একবার জোর করে চায়ের তোয়ালের কাজে লাগানো চেষ্টা চালানো হয়েছিল। কিন্তু সানন্দে তিনটা মদের গ্লাস ভেঙ্গেছিল সে। নিজের আনাড়িপনায় নিজেই চিৎকার করে উঠেছিল। আর তারপর থেকে তাকে শান্তিতে থাকতে দেওয়া হয়েছে।

প্রু বলে, ‘আরও কফি লাগবে?’ খোলা শার্ট ও রুমালদুটো দেখিয়ে জর্জের কাছে এসে দাঁড়ায় সে। জর্জ নিশ্চিত না যে, সে আবার কোনও কিছু নতুন করে শুরু করবে কিনা। কিন্তু বইয়ের তাকের ওপরে কফিটা রেখে সে প্রুর নিতম্বে হাত রাখে। সে তার সুযোগগুলো বাছাই করে দেখতে চায়। নিশ্চিত হতে চায় যে, সে এখনও কাঙ্খিত। প্রু দীর্ঘশ্বাস ফেলে। কামনা কিংবা ধৈর্যচ্যূতি অথবা দুটোরই লম্বা একটা দীর্ঘশ্বাস।

প্রু বলে, ‘ওহ, জর্জ! তোমার সাথে আমার কী করা উচিৎ?’

মুখটা প্রুর কানের কাছে এনে জর্জ বলে, ‘তোমার যা ইচ্ছে। আমি তো শুধু তোমার হাতের পুতুল।‘ প্রুর কানের লতিতে ছোট্ট রূপালি একটা দুল শঙ্খের মতো ঝুলে আছে। ঠোকরানোর বেগটাকে জর্জ দমন করে।

জর্জের জন্য নিজের পুরান একটা ডাক নাম ব্যবহার করে প্রু বলে, ‘কৌতূহলী জর্জ, তোমার তো কচি পাঠার চোখ ছিল। কামুক চোখ।‘

জর্জ ভাবে, আমি তাহলে এখন বুড়ো পাঠা। নিজেকে সামলাতে পারে না সে। আবার কচি হতে চায়। হাত চালায় প্রুর শার্টের নিচে।

বিজয়িনীর উল্লাসে প্রু বলে, ‘পরে।‘ জর্জের কাছ থেকে নিজে ছাড়িয়ে নিয়ে অনিশ্চল হাসি দেয় সে। আর জর্জের কনুই লেগে তার কফি কাপটা পড়ে যায়।

জর্জ বলে, ‘গুষ্টি কিলাই (ফেনে এগিয়ে মেগ)।‘ শুনে প্রু হাসে। এসব গালিগালাজের মানে সে বোঝে। এর চেয়েও খারাপগুলোরও বোঝে।

প্রু বলে, ‘আনাড়ি হাঁদারাম। স্পঞ্জ আনতে যাচ্ছি আমি।‘

একটা সিগারেট ধরিয়ে জর্জ প্রুর ফিরে আসার অপেক্ষা করে। কিন্তু পামেলাই এসে হাজির হয়। ঘষামাজা করার নোংরা এক টুকরো ন্যাকড়া ও ধাতব একটা গামলা নিয়ে দরজার প্রবেশপথে এসে ভেংচি কাটে। প্রুর ওপর আস্থা রাখুন যে, সে অন্য কোনও জরুরী কাজ পেয়ে গিয়েছে। সে সম্ভবত বহিঃস্থ ঘরে আছে। ম্যাগাজিন পড়ছে ও ষড়যন্ত্র করছে। পরে কখন কোথায় জর্জকে প্ররোচিত করবে সেটা ঠিক করছে।

জর্জ যেন একটা কুকুরছানা—এমন ভাব নিয়ে পামেলা বলে, ‘তা জর্জ। তুমি তো দেখছি সব এলোমেলো করে ফেলেছ।‘ জর্জ ভাবে, পামেলার যদি ভাঁজ করা পত্রিকা থাকত, তবে সেটা দিয়ে আমার নাকে ঘা দিত।

জর্জ অমায়িকভাবে বলে, ‘কথা সত্য। আমি তো “ওফ” (হাঁদারাম)। কিন্তু তুমি তো সব সময়ের জন্যই সেটা জানো।‘

হাঁটু গেড়ে বসে পামেলা মুছতে শুরু করে। বলে, ‘”লোফ” এর বহুবচন যদি “লোভজ’ হয়, তাহলে “ওফ” এর বহুবচন কী হবে? “ওভজ” নয় কেন?’ জর্জ উপলব্ধি করে যে, পামেলা যা বলে তার অনেকটাই তাকে কিংবা অন্য কোনও শ্রোতাকে লক্ষ করে নয়, বরং নিজেকে লক্ষ করে বলে। এর কারণ কি এই যে, কেউই তার কথা শুনতে পারে না? পামেলার হাঁটু গেড়ে বসাকে জর্জের কাছে ইঙ্গিতপূর্ণ লাগে, নাড়া দেওয়ার মতোও লাগে। পামেলার গন্ধ পায় সে। সাবানের গুড়ার গন্ধ, মিষ্টি কিছু একটার রঞ্জন। হাতে মাখার লোশন? পামেলার গলা ও ঘাড় তো কমনীয়। জর্জ ভেবে পায় না তার কোনও প্রেমিক আছে কিনা। আর থাকলেও সে কিসের মতো। অসংবেদনশীল পুরুষ, যার দক্ষতার অভাব আছে। একটা হাঁদারাম।

না ঘুরেই পামেলা বলে, ‘জর্জ, চুলার মতো ধূমপান করো তুমি। তোমার আসলেই ক্ষান্ত হওয়া উচিৎ। নইলে এটা তোমাকে মেরে ফেলবে।‘

‘চুলার মতো ধূমপান করা’ কথাটাকে জর্জের কাছে দ্ব্যর্থবোধক ঠেকে। নিজেকে ড্রাগন হিসেবে দেখতে পায় যে তার বিশাল ক্ষুধার্ত মুখ থেকে লাল লাল শিখা উদগীরণ করে। এটা কি আসলেই জর্জের জন্য প্রুর সংস্করণ? সামনাসামনি আক্রমনের চেষ্টাতাড়িত হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে জর্জ বলে, ‘তুমি এতে খুশি হবে। আমাকে ছয় ফুট মাটির নিচে দেখতে পেতে চাও তুমি। তুমি কখনই আমাকে পছন্দ করনি।‘

মোছা বন্ধ করে পামেলা কাঁধের ওপর দিয়ে জর্জের দিকে তাকায়। তারপর দাঁড়িয়ে নোংরা কাপড় চিবিয়ে পানি বের করে গামলায় রাখে। শান্তভাবে বলে, ‘এটা কিশোরসুলভ আচরণ, যা তোমাকে মানায় না। আরও চর্চার দরকার তোমার। আজ বিকেলে তোমাকে ক্যানো ভ্রমণে নিয়ে যাব।‘

সত্যবাদীতার সাথে জর্জ বলে, ‘তুমি তো জানো ওতে নিরাশ আমি। সব সময় শিলায় গিয়ে ঠেকে। কখনই দেখতে পাই না।‘

পামেলা যেন নিজেকেই বলে, ‘ভূতত্ত্বই নিয়তি।‘ কাচের ঘন্টায় পুরে থাকা লুন হাঁসের দিকে ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে তাকায় সে। ভাবছে। অবশেষে বলে, ‘হ্যাঁ, এ জলাশয়টা লুকায়িত শিলায় শিলায় ভরা। বিপজ্জনক হতে পারে। তবে আমি তোমার দিকটা দেখব।‘

জর্জের সাথে কি সে ছিনালি করছে? খাড়া শিলা কি ছিনালি করতে পারে? জর্জের তো বিশ্বাসই হতে চায় না, তবু মুখের কেন্দ্রে সিগারেটটা ধরে ছেদন দাঁতগুলো দেখিয়ে পামেলাকে হাসি দেয়। আর তাদের জীবনে প্রথম বারের মতো পামেলাও ফিরতি হাসি দেয়। মুখের কোণাগুলো যখন ওপরে বেঁকে যায়, তখন তার মুখটা সম্পূর্ণরূপে ভিন্ন হয়। যেন জর্জ তাকে উল্টো দিক থেকে দেখছে। পামেলার হাসির কমনীয়তায় জর্জ বিস্মিত হয়। প্রুর হাসির মতো চেনা হাসি নয় কিংবা পোর্শিয়ার হাসির মতো সাধু-সন্নাসিনীর হাসি নয় এটা। এ হচ্ছে শয়তানের বাচ্চার হাসি, দুষ্টু শিশুর হাসি। তা এমন কিছুর সাথে মিশে গেছে যা জর্জ পামেলার মধ্যে দেখতে পাবে তা কখনও আশা করেনি। এক ধরণের উদারতা, এক ধরণের উদাসীনতা, এক ধরণের বদান্যতা। পামেলার এমন কিছু একটা আছে যা সে জর্জকে দেওয়ার বাসনা পোষণ করে। সেটা কী হতে পারে?

মধ্যাহ্ন ভোজ ও তা হজমের বিরতির পর রান্নাঘরের পিছনে কাঠের চালার পাশে রোলান্ড কাঠ চিরতে ফিরে যায়। ভূর্জ গাছের কাঠ চিরছে সে। গাছটি এক বছর আগের কাটা একটা মরা গাছ। বীভার প্রাণীরা কাটার কাজটি শুরু করেছিল, কিন্তু তারা তাদের সিদ্ধান্ত বদল করেছিল। শ্বেত ভূর্জ গাছ অবশ্য বেশি দিন বাঁচেও না। রোলান্ড শিকল করাত দিয়ে গুড়িটা পরিপাটি করে কেটেছিল। করাতের ব্লেড কাঠের মধ্যে এমনভাবে যাচ্ছিল যেন মাখনের মধ্য দিয়ে ছুরি চালানো হচ্ছিল। গাছটি চেরার আওয়াজ বাতাস, ঢেউ—সব কিছুর আওয়াজ এবং জলাশয়ের ওপারে মহাসড়ক থেকে আসা ট্রাকের ভট ভটকে শুষে খাচ্ছিল। যন্ত্রের আওয়াজ ভালো লাগে না রোলান্ডের। তবে নিজে আওয়াজ করালে, নিজে আওয়াজ নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে সেটা সহ্য করা সহজতর। বন্দুকের আওয়াজের মতো।

এমন না যে রোলান্ড গুলি ছোড়ে। ছুড়ত। সময় হলে হরিণ শিকারে বাইরে বেরোত। কিন্তু এখন তা অনিরাপদ। এত বেশি মানুষজন শিকার করছে—ইতালিয়ান এবং কে জানে কে কখন চলমান কিছুতে গুলি ছোড়ে। যা হোক না কেন, চূড়ান্ত পরিণতির রুচিটা সে হারিয়ে ফেলেছে। হারিয়ে ফেলেছে কিম্ভুতকিমাকার মাথার অলঙ্কারের মতো গাড়ির সামনের অংশে বাঁধা শিংওয়ালা হরিণের মৃতদেহের রুচি। হারিয়েছে চমৎকার, নিহত মাথাগুলো মিনিভ্যানের ওপর থেকে মলিন দৃষ্টিতে উঁকি মারার রুচি। হরিণের মাংসের বিষয়টা সে বুঝতে পারে। বুঝতে পা খাওয়ার জন্য হত্যা করাটাকে। কিন্তু আপনার দেয়ালে কাটা মাথা রাখার ব্যাপারটা? হরিণ যে ট্রিগার টানতে পারে না সেটা ব্যতীত এতে কী প্রমাণিত হয়?

এসব অনুভূতি নিয়ে সে কখনও কথা বলে না। সে জানে কর্মক্ষেত্রে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে হরিণ ধরা হবে। আর তার কর্মক্ষেত্রকে তো সে ঘৃণা করে। তার কাজ হচ্ছে অন্য মানুষের জন্য টাকার ব্যবস্থা করা। সে জানে তার প্রপিতামহের মানদণ্ডে সে সফল নয়। সে যখন দাঁড়ি কামায়, বুড়ো লোকটি তখন প্রতিদিন সকালে ওয়াশরুমের রোজউড ফ্রেম থেকে তাকে বিদ্রুপ করে। তারা দুজনেই একই জিনিস জানে। রোলান্ড যদি সফল হত, তবে সে লুণ্ঠন করতে বের হত, মাছি মারত না। তার ধূসর, অনাক্রমাত্মক, অসন্তুষ্ট কোনও একজন লোক যে তার হয়ে মাছি মারত। একটা বাহিনী থাকত। তার নিজের মতো মানুষের এক বাহিনী।

ভূর্জ গাছের একটা ফালি তুলে সে খাড়া করে এবং কুঠার দোলায়। একটা নিপাট কোপ দিতে চায়, কিন্তু অনেক দিন থেকে অভ্যাস নেই তার। কালকেই ফোস্কা পড়বে। একটু পরেই সে থামবে, অবনত হবে ও স্তূপীকৃত করবে, অবনত হবে এবং স্তূপীকৃত করবে। এরই মধ্যে যথেষ্ট কাঠ হয়ে গেছে। তবে এটা করতে তার ভালো লাগছে। এ রকম অল্প কিছু জিনিস আছে যা তার ভালো লাগে। এখানেই সে কেবল প্রাণবন্ত বোধ করে।

গতকাল সে ওয়্যারহাউস, ফ্যাক্টরি ও চকচকে কাচের টাওয়ারগুলো অতিক্রম করে শহরের কেন্দ্র থেকে গাড়ি চালিয়েছিল। টাওয়ারগুলোকে মনে হচ্ছে রাতারাতি ওপরে চলে গেছে। আরও অতিক্রম করেছিল উপবিভাগগুলো। সে শপথ করে বলতে পারে এগুলো গত বছর, গত মাসেও ছিল না। একরের পর একর জুড়ে বৃক্ষশূন্যতা, একরের পর একর জুড়ে তাঁবুর মতো, আক্রমণের মতো ছোট ছোট তীক্ষ্ন ছাদসহ নতুন নতুন টাউনহাউস। গথ ও ভ্যান্ডালদের তাঁবু। হান ও ম্যাগিয়ারদের তাঁবু। জর্জের তাঁবু।

তার কুঠারটা জর্জের মাথায় নেমে এসে মাথাটা দু’ভাগ করে ফেলে। রোলান্ড যদি জানত যে এ সপ্তাহান্তে জর্জ এখানে থাকবে, তাহলে সে আসত না। প্রুর গোষ্ঠী কিলাই, তার নির্বোধ রুমালের গোষ্ঠী কিলাই, তার খোলা শার্টের গোষ্ঠী কিলাই, মধ্য বয়সে এগিয়ে দেওয়া তার গরম মাইদুটোর গোষ্ঠী কিলাই, সার্ডিন মাছ ও পনিরের সাথে মাফিনের গোষ্ঠী কিলাই। প্রুর দিকে গোপনে তেলতেলে চোখ দেওয়া জর্জের গোষ্ঠী কিলাই, যেখানে পোর্শিয়া দেখেও না দেখার ভান করে। জর্জ ও তার অবৈধ কারবারের, শহরের কাউন্সেলরদেরকে তার ঘুষ দেওয়ার গোষ্ঠী কিলাই। জর্জ ও তার লাখ লাখ টাকাকড়ির, তার ভেজাল, অতিরিক্ত মুগ্ধতার গোষ্ঠী কিলাই। যে শহর জর্জের তার তো সেই শহরেই থাকা উচিৎ। তাকে সেখানে নেওয়াটাও মুশকিল। তবে রোলান্ড অন্ততপক্ষে তার পথ থেকে দূরে থাকতে পারে। এখানে এই ওয়াকুস্টা লজে সে অসহ্য। এমন সদর্পে ঘুরে বেড়ায় যেন জায়গাটার মালিক সে-ই। এখনও হয়নি। সম্ভবত সব কিছু ক্রোক করা পর্যন্ত সে অপেক্ষা করবে। করে বিত্তশালী জাপানীজদের জন্য লাভজনক বৃদ্ধাশ্রম বানাবে। বিশাল লভ্যাংশে সব বিক্রি করে দেবে। এ রকম কাজই জর্জ করবে।

রোলান্ড প্রথম বার যখন এ লোকটিকে দেখে তখনই জানত যে, সে হচ্ছে টিকটিকি। পোর্শিয়া কেন ওকে বিয়ে করতে গেল? জর্জকে প্রুর কাছে ছেড়ে দিয়ে সে তো ভদ্র কাউকে বিয়ে করতে পারত। ঈশ্বর জানেন প্রু তাকে কোত্থেকে তুলে এনেছিল। তুলে এনে দামী মাছের মতো তাকে নিয়ে সগর্বে বলে বেড়াচ্ছিল। পোর্শিয়া নয়, প্রুই তার যোগ্য ছিল। কিন্তু কোনও চেষ্টা ছাড়াই প্রু কেন তাকে ছেড়ে দিল? এটা তো তার স্বভাবজাত ছিল না। মনে হচ্ছে যেন তাদের দুজনের মধ্যে কিছু সলা-পরামর্শ হয়েছিল, অদৃশ্য কোনও চুক্তি হয়েছিল। পোর্শিয়া জর্জকে পেয়েছিল, কিন্তু তার জন্য কী আপোস করেছিল সে? কী ত্যাগ করেছিল?

পোর্শিয়া তো সব সময়ের জন্য রোলান্ডের প্রিয় বোন ছিল। সবার ছোট ছিল সে। একটা শিশু। প্রু ছিল পোর্শিয়ার বড়। এই প্রু তাকে অসভ্যভাবে তিরস্কার করত। পোর্শিয়া যদিও কান্না করার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্যভাবে ধীর ছিল। তার পরিবর্তে সে শুধু তাকাত যেন সে কোনওভাবেই বুঝে উঠতে পারত না যে, প্রু তার সাথে কী করছিল অথবা কেন করছিল? তারপর সে নিজে নিজেই চুপসে যেত। তা না হলে রোলান্ড এসে তার পক্ষ নিত। এতে মারামারি লেগে যেত। আর তার বোনের সাথে অসদাচারণের দায়ে রোলান্ডকে অভিযুক্ত করা হত। আর বলা হত যে, তার ও রকম আচরণ করা শোভন নয়। কারণ সে ছেলে মানুষ। রোলান্ড মনে করতে পারছে না যে, এসবের কোনখানে পামেলার অংশগ্রহণ থাকত।

পামেলাই ছিল বাকিদের মধ্যে সবচেয়ে বড়। তার ছিল নিজস্ব কর্মসূচী যাতে অন্য কেউ কোনওভাবে অন্তর্ভূক্ত ছিল বলে মনে হয় না। ডাইনিং টেবিলে পড়ত সে। আর নিজেই ক্যানো নৌকা করে চলে যেত। এসব কাজে তাকে অনুমতি দেওয়া ছিল।

শহরে তারা ভিন্ন ভিন্ন স্কুলে কিংবা ভিন্ন ভিন্ন শ্রেণিতে ছিল। বাড়িটা ছিল বিশাল। আর এর মধ্য দিয়ে অথবা পশুর খোঁয়াড়ের মধ্য দিয়ে তারা নিজেদের পথ বের করে নিত। এখানেই শুধু একটা জায়গার সাথে আরেকটা জায়গার সীমানা লীন হয়ে যেত। ওয়াকুস্টা লজটিকে খুবই শান্ত দেখায়। রোলান্ডের জন্য তা পারিবারিক যুদ্ধের আকর।


২য় পর্ব                                                                                                                            ৪র্থ পর্ব

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*