ট্রু ট্রাশ – অনুবাদ

ট্রু ট্রাশ

ট্রু ট্রাশ

মূল: মার্গারেট এটউড

অনুবাদ: সেলিম মিয়া


মিস ফিস্ক রান্নাঘরে যান। দেখতে ছোট-খাটো, গোলগাল ও বিভ্রান্ত। তিনি সব সময় খোপায় হেয়ারনেট পরে থাকেন। আঙুলে কিছু একটা সমস্যা থাকার জন্য পায়ে পরেন পশমি জুতা। আর পরেন হাঁটু পর্যন্ত বিস্তৃত বিবর্ণ নীল রঙের সোয়েটার কোট। তা যতই গরম পড়ুক না কেন। গ্রীষ্মকালীন এই চাকুরিটাকে তিনি তার ছুটি হিসেবে ভাবেন। মাঝে মাঝে ঝোলানো বুকে গোসলের কাপড় পরে এবং কান খাড়া করে সাদা রাবারের টুপি পরে তাকে পানিতে ডোবাডুবি করতে দেখা যায়। তবে মাথা কখনও ভেজান না। তাই টুপি কেন পরেন তিনি সেটা যে কেউ অনুমান করতে পারে।

‘আচ্ছা, মেয়েরা। শেষ হলো তোমাদের?’ তিনি পরিচারিকাদের কখনও নাম ধরে ডাকেন না। তাদের সামনাসামনি বলেন মেয়েরা , আর তাদের পিছনে বলেন আমার মেয়েরা। তার কোনও কিছু ঠিক মতো না হলে সেটার অজুহাত হিসেবে ব্যবহৃত হয় তারা। যেমন—মেয়েদের কেউ এটা করে থাকবে।  এক ধরণের অভিভাবক হিসেবেও কাজ করেন তিনি। তার ক্যাবিনটা পরিচারিকাদের ক্যাবিনের মধ্যবর্তী পথে। আর তার বাঁদুড়ের মতো রাডারের কান আছে।

জোয়ান ভাবে, আমি অমন বুড়ি কখনও হব না। ত্রিশ হওয়ার আগেই মারা যাব। সে এটা পুরোপুরিই জানে। ভাবনাটা করুণ যদিও, তবুও সন্তোষজনক। দরকার হলে, কোনও অপচয়কারী রোগ তাকে নিতে অস্বীকৃতি জানালে, বড়ি খেয়ে সে নিজেই তা সমাধা করবে। সে তো মোটেও অসুখী না। তবু পরে সে তা হতে চায়। মনে হচ্ছে প্রয়োজন।

জোয়ান মনে মনে আওড়ায়, এ দেশ বুড়োদের দেশ না। তার মুখস্থ করা একটা কবিতা, যদিও পরীক্ষায় আসেনি। বুড়োদের জায়গায় শুধু বুড়ি বসিয়ে দেয়।

তাদের সবাই যখন পাজামা পরে ঘুমাতে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত, জোয়ান তখন ট্রু ট্র্যাশের বাকি গল্পটা পড়ার প্রস্তাব করে। কিন্তু সবাই এত ক্লান্ত যে শেষ অনুজ্জ্বল বাতিটা নিভে যাওয়ার পর ফ্ল্যাশ বাতি জ্বালিয়ে রেখে সে শুধু নিজেই পড়ে। কোনও কিছুর শেষ না দেখা পর্যন্ত সে ক্ষান্ত হয় না। কখনও কখনও সে বইয়ের পিছন থেকে পড়া শুরু করে।

বলা বাহুল্য, মারলিনের পেটে বাচ্চা আসে, আর ডার্ক সেটা জানতে পেরে তার মোটরসাইকেলে চড়ে চম্পট দেয়। স্থির হওয়ার মতো মানুষ নই আমি, সোনা। পরে দেখা হবে। ভ্রুম। মারলিনের মা বাস্তবেই খুব ভেঙে পড়েন। কারণ অল্প বয়সে তিনিও একই ভুল করেছিলেন এবং সব সম্ভাবনাকে নস্যাৎ করেছিলেন। আর এখন দেখেন তার অবস্থা। মারলিন কান্নাকাটি করে, অনুতপ্ত হয় এবং প্রার্থনাও করে। কিন্তু সৌভাগ্যবশত, আরেক জন যে বিরক্তিকর জুতার কেরানি ছিল, সে এখনও তাকে বিয়ে করতে চায়। আর তা-ই ঘটে। মা তাকে ক্ষমা করে দেন। আর মারলিন নীরব ভক্তির সত্যিকারের মূল্য দিতে শেখে। তার জীবনে হয়ত উত্তেজনা নেই। কিন্তু ট্রেইলার পার্কে তিন জন ভালো জীবন কাটাচ্ছে। শিশুটা আদর করার মতো। তারা একটা কুকুর কেনে। আইরিশ কুকুর। গোধূলি লগ্নে শিশুটি যখন হেসে ওঠে, কুকুরটি তখন লাঠি তাড়া করে। গল্পটা এভাবেই কুকুর দিয়ে শেষ হয়।

ছোট্ট সংকীর্ণ বিছানা ও দেয়ালের মাঝখানে জোয়ান ম্যাগাজিনটা গুঁজে রাখে। সে কাঁদছে প্রায়। ও রকম কুকুর অথবা শিশু সে কখনই পাবে না। তাদের চায় না সে। আর সব কিছু তাকে করিয়ে নিতে হবে বিবেচনা করলে তার আর সময়ই-বা কই থাকে? অস্পষ্ট হলেও তার দীর্ঘ একটা কর্ম-পরিকল্পনা আছে। তা সত্ত্বেও, সে বঞ্চিত বোধ করে।

গোলাপি গ্রানাইটের ডিম্বাকার দুটো পাহাড়ের মাঝে আছে একটি ছোট অর্ধ-চন্দ্রাকার বেলাভূমি। ছেলেরা গোসলের পোশাক পরে (নৌবিহারে তারা কখনই তা পরে না। শুধু ক্যাম্পের কাছাকাছি যেখানে মেয়েরা তাদের দেখতে পারে সেখানে পরে)  কাপড়-চোপড় ধোয়া-কাচার কাজ করছে। হাঁটুতে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হলুদ রঙা সানলাইট সাবান মিশিয়ে তাদের ভেজা টি-শার্ট ও আন্ডারপ্যান্ট ধুচ্ছে। কাপড়-চোপড়ের ঘাটতি পড়লেই শুধু তাদের এমন ঘটে। অথবা ক্যাবিনে নোংরা মোজার দুর্গন্ধ চারদিকে ছড়িয়ে পড়লেই এমন ঘটে। কাউন্সেলর ডার্স শিলার ওপর হাত-পা ছড়িয়ে দিয়ে তত্ত্বাবধানের কাজটি করছেন। এরই মধ্যে তামাটে হয়ে যাওয়া শরীরে রোদ পোহাচ্ছেন এবং ধূমপান করছেন। ক্যাম্পারদের সামনে ধূমপান করা নিষেধ হলেও তিনি জানেন এই দলটি কিছু বলবে না। নিরাপদ অবস্থানে থাকার জন্য তিনি লুকিয়ে লুকিয়ে ধূমপান করছেন। সিগারেটটি ধরে রেখেছেন শিলার কাছাকাছি নিচে এবং চুরি করে দ্রুত টান দিচ্ছেন।

ডনির মাথার এক পাশে কী যেন একটা এসে লাগে। এটা রিচির ভেজা আন্ডারপ্যান্ট। নিষ্পেষিত হয়ে বলের আকার ধারণ করেছে। ডনি সেটা পাল্টা ছুঁড়ে মারে। আর শীঘ্রই আন্ডারপ্যান্ট-আন্ডারপ্যান্ট যুদ্ধ বাঁধে। মন্টি এ যুদ্ধে যোগ দিতে অস্বীকৃতি জানায়। তাই সে সবার লক্ষ্য বস্তুতে পরিণত হয়। সে চেঁচিয়ে বলে, ‘ভাগ!’

ডার্স বলেন, ‘এসব বাদ দাও তোমরা।‘ কিন্তু এদিকে আসলেই তার মনোযোগ নেই। তিনি দেখছেন অন্য কিছু। দেখছেন গাছগুলোর মাঝে নীল ইউনিফর্মের ঝলকানি। দ্বীপের এ দিকটায় পরিচারিকাদের আসার কথা না। বিকেলের বিরতির সময় নিজেদের ডকে থাকার কথা তাদের।

গাছগুলোর মাঝে ডার্স এখন উঠে দাঁড়িয়েছেন। এক হাতে তার শরীর আঁকড়ে ধরে রেখেছেন। কথাবার্তা চলছে। গুঞ্জন হচ্ছে। ডনি জানে এটা রনেট। আকার দেখে, চুলের রঙ দেখেই সে বলে দিতে পারে। আর এই তো সে। ধোলাই বোর্ডে পাঁজরগুলো দেখা যাচ্ছে। দেখা যাচ্ছে তার লোমহীন বুক। বাচ্চাদের মতো করে আন্ডারপ্যান্ট ছুঁড়ে মারছে। নিজের প্রতি সে বিতৃষ্ণ।

পরাজয়ের সংখ্যা অনেক হলেও মন্টি তা স্বীকার করতে চায় না। সে বলে, তার হাগু করা দরকার। বলেই ঘর-সংলগ্ন বাহিরের টয়লেটের দিকে অদৃশ্য হয়ে যায়। এর মধ্যে ডার্সকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না। মন্টির কাপড় কাচা শেষ হলে ডনি মন্টির কাপড়-চোপড় কব্জা করে। মন্টি ইতোমধ্যেই কাপড়গুলো চিপিয়ে গরম শিলার ওপরে পরিপাটি করে শুকাতে দিয়েছে। ডনি মন্টির আন্ডারপ্যান্ট ছিড়ে টুকরো টুকরো করে জ্যাক পাইন গাছের মধ্যে ছুঁড়ে মারে। অন্যরা সানন্দে তাকে সাহায্য করে। মন্টি ফিরে এসে দেখে গাছটি তার আন্ডারপ্যান্ট দিয়ে সাজানো, আর দেখে অন্য ছেলেরা নিস্পাপের মতো আলতো করে কাপড় ধুচ্ছে।

তারা চারজন একটা গোলাপি গ্রানাইট দ্বীপে আছে: জোয়ান ও রনেট, পেরি ও ডার্স। ডাবল ডেট এটা। দুটো নৌকা পানির অর্ধেক দূরত্বে টেনে এনে জ্যাক পাইন গাছের সাথে নিয়মমাফিক রশি দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছে। আগুনটা জ্বলে জ্বলে কয়লায় এসে মিইয়ে যাচ্ছে। পশ্চিমাকাশ এখনও পিচ ফলের মতো উজ্জ্বল ও দীপ্ত। নরম পাকা রসের চাঁদ উঠছে। সন্ধ্যার বাতাস উষ্ণ ও সুমিষ্ট। ঢেউগুলো শিলায় এসে মৃদু আছড়ে পড়ছে। জোয়ান ভাবে, এটা গ্রীষ্মকালীন সংখ্যা। লেজি ডেজ। ট্যানিং টিপস। শিপবোর্ড রোমান্স।

জোয়ান মার্সম্যালো চকোলেট বাদামি-গরম করছে। এটা করার বিশেষ একটা রীতি আছে তার। কয়লার কাছাকাছি ধরে রাখে। তবে এত কাছাকাছি না যে আগুন ধরে যায়। বালিশের মতো যেন ফুলে-ফেঁপে ওঠে ও হালকা বাদামি হয় ঠিক তেমন কাছাকাছি ধরে রাখে। তারপর বাদামি আবরণ ছিড়ে সে খাওয়া শুরু করে। ভেতরের সাদা অংশটা ছাড়িয়ে নিয়ে আবার একইভাবে বাদামি-গরম করে। আঙুলে লেগে থাকা মার্সম্যালোর রস চেটে চেটে খায়, আর কয়লাগুলোর পরিবর্তনশীল আভায় ব্যথাতুর দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। এর সব কিছুই হচ্ছে আশপাশে আসলে যা কিছু হচ্ছে তা উপেক্ষা করার কিংবা উপেক্ষার ভান করার উপায়।

তার গালে এক ফোঁটা অশ্রু চিত্রিত ও স্থির হয়ে পড়ে থাকতে পারে। হার্টব্রেক  ক্যাপশনও থাকতে পারে। তার ঠিক পিছনে বিছানা চাদরে আছে পেরি, যার হাঁটুটা তার পিঠকে স্পর্শ করে আছে, যে বিরক্ত হয়ে আছে। কারণ জোয়ান তার সাথে চুমাচুমি করবে না। আগুন-আলোর অনুজ্জ্বল বলয় থেকে শিলাগুলোর বেশ পিছনে আছে রনেট ও ডার্স। জুলাইয়ের তৃতীয় সপ্তাহ চলছে। সবাই জানে, এ সময় তারা জোড়ায় জোড়ায় থাকে। বিনোদন হলে সেন্ট জুড ক্রেসসহ সোয়েটশার্ট পরে রনেট। ইদানিং বেশ হাসে। এমনকি হো হো করে হাসে অন্য মেয়েরা যখন ডার্সের ব্যাপারে তাকে টিটকারি মারে। টিটকারি মারার সময় হিলারি যোগ দেয় না। রনেটের মুখ আরও গোল, আরও সুস্থ মনে হয়। মুখের কোণগুলো মসৃণ হয়ে ওঠে যেন কেউ হাত দিয়ে ঠিক করে দিয়েছে। সে কম সতর্ক, কম দ্বিধাগ্রস্ত। জোয়ান ভাবে, রনেটেরও একটা ক্যাপশন থাকা উচিৎ। ওয়াজ আই টূ ইজি?

অন্ধকার থেকে খসখস শব্দ, ছোট-খাটো গুঞ্জন, নিঃশ্বাসের শব্দ আসছে। যেন শনিবার রাতের নাটক-সিনেমার মতো। দল বেঁধে মাখামাখি।যুবক-যুবতীরা একে অপরের বাহুডোরে। জোয়ান ভাবে, তারা সম্ভবত কোনও র্যাটল সাপকে বিরক্ত করছে।

জোয়ানের কাঁধে দ্বিধাগ্রস্তভাবে হাত রাখে পেরি। জোয়ান ভদ্রভাবে বলে, ‘তোমাকে কি মার্শম্যালো গরম করে দেবো?’ শীতল ভাব। পেরি কোনও সান্ত্বনা পুরস্কার নয়। তার রোদে পোড়া ত্বক ও স্প্যানিয়াল কুকুরের ব্যাকুল চোখ দিয়ে সে শুধু জোয়ানকে জ্বালাতন করে। জোয়ানের তথাকথিত প্রকৃত ছেলেবন্ধুটিও কোনও কাজে আসে না। সে শুধু ট্রেনের কু-ঝিক-ঝিক, কু-ঝিক-ঝিক শব্দে প্রেইরি অঞ্চলের এপাশ-ওপাশ আসা-যাওয়া করে। শুধু কালির অক্ষরে মাঝে-সাঝে চিঠি লেখে। তার মুখের ছবিটা যেন পানিতে ভিজে প্রায় মুছে গেছে।

জোয়ান আসলে ডার্সকেও চায় না। সে তা-ই চায় যা রনেটের আছে: মন্তব্য ও আপত্তি সত্ত্বেও নিজেকে সঁপে দেওয়ার ক্ষমতা। এটা সেই আলস্য, পিছনের দিকে হেলান দিয়ে থাকা। আনন্দময় উদাসীনতা। জোয়ান যা কিছুই করে তাকে ঘিরে প্রশ্নবোধক চিহ্ন থাকে।

বিষন্ন, প্রতারিত কণ্ঠে পেরি বলে, ‘মার্শম্যালো।‘ আবার সেই প্যাডলিং? কী জন্য? কেনই-বা সে এলো যদি একটু মাখামাখি না করে?

আচরণ বিচ্যূতির জন্য জোয়ান অপরাধ বোধে ভোগে। পেরিকে চুমু দিলে কি খুব বেশি কষ্ট হবে?

হ্যাঁ, হবে।

মূল ভূখণ্ডের জট পাকানো ঝোঁপ-জঙ্গলের মধ্যে ডনি ও মন্টি ক্যানো নৌ ভ্রমনে বের হয়েছে। ক্যাম্প আডানাকি তো ভ্রমনের জন্য বিখ্যাত। পাঁচ দিন ধরে তারা দুজন ও অন্যরা, সব মিলিয়ে বারো জন, বন্দরের প্রবেশপথের মূস প্রাণীর জলপান ও দুর্গন্ধের মধ্য দিয়ে অথবা ঢেউ-সৃষ্ট বোল্ডারের ওপর দিয়ে লেকের পর লেক দাঁড় টানছে, গিয়ার টানছে। বোঁচকা ও ক্যানো নৌকা নিয়ে পাহাড়ের ওপর কষ্ট করে উঠছে। সাথে মশাকে পা দিয়ে তাড়াচ্ছে। মন্টির হাতে-পায়ে ফোস্কা পড়ে গেছে। ডনি এ জন্য খুব একটা খারাপ বোধ করছে না। তার নিজেরই একটা ক্ষত টুকরো আছে। সে হয়ত রক্ত-বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হতে পারে। বিকারগ্রস্ত হতে পারে। শিলা ও পাইন গাছের সুচাগ্রের মধ্যে টানাটানি করতে গিয়ে হয়ত ধপাস করে পড়ে মরে যেতে পারে। তাতে কারও না কারও উচিৎ শিক্ষা হবে। সে যে ব্যথা পাচ্ছে তার জন্য কারও না কারও মূল্য দেওয়া উচিৎ।

ডার্স আর পেরি হচ্ছে কাউন্সেলর। দিনের বেলায় তারা ক্ষমতা বলে কঠোরভাবে কাজ করিয়ে নেয়, আর রাতের বেলায় শিলা বা গাছে পিঠ ঠেকিয়ে আরাম করে, ধূমপান করে, এবং তদারকি করে বেড়ায়। ওদিকে ছেলেরা আগুন জ্বালায়, পানি বয়ে নিয়ে আসে, ক্র্যাফট ডিনার রাঁধে। তাদের দুজনেরই বড় বড় মসৃণ পেশি আছে। পেশিুগুলো তামাটে ত্বকের নিচে ঢেউ খেলে। এরই মধ্যে দুজনেরই খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি গজিয়েছে। সবাই সাঁতার কাটতে গেলে ডনি ঈর্ষান্বিত, চোরা চাহনিতে তাদের কটিদেশের তাকিয়ে থাকে। এতে সে নিজেকে লম্বা ও সরু বোধ করে। আর নিজের কামনায় শিশুসুলভ বোধ করে।

এখন রাত। পেরি ও ডার্স এখনও জেগে আছে। নিচু স্বরে কথা বলছে। নিভু নিভু আগুনে না-পোড়া কাঠের টুকরোগুলো ঠেলে দিচ্ছে। ছেলেদের ঘুমিয়ে পড়ার কথা। যদি বৃষ্টি আসে, সে জন্য তাঁবু আছে। কিন্তু গত পরশুর পর থেকে কেউ সেটা টাঙানোর কথা বলেনি। ময়লা ও ঘর্মাক্ত পায়ের গন্ধ, কাঠের ধোঁয়া খুব কাছ থেকেই স্পষ্ট হয়ে উঠছে। ঘুমানোর থলেগুলো পনিরের মতো উচু হয়ে উঠছে। থলের মধ্যে কুণ্ডলী পাকিয়ে বাইরে থাকাই বেশি ভালো। বড় ধরণের বন্যা হলে মাটিতে বিছানো চাদর তো আছেই। উল্টানো ক্যানো নৌকার নিচে মাথাও রাখা যাবে।

মন্টিই একমাত্র তাঁবুর পক্ষে ভোট দিয়েছে। পোকা-মাকড় তার দিকে আসছে। সে বলে তার অ্যালার্জি আছে। ক্যানো নৌকায় ভ্রমণকে সে ঘৃণা করে, আর সেটা কোনও গোপন বিষয় না। সে বলে, বয়স হলে পরিবারের অর্থ-কড়িতে হাত চালাতে পারবে। সেই টাকা দিয়ে সে খ সাহেবের কাছ থেকে জায়গাটি কিনে এটা বন্ধ করে দেবে। সে বলে, ‘যে প্রজন্মের ছেলেরা এখনও জন্মেনি তারা আমাকে ধন্যবাদ জানাবে, উপাধি প্রদান করবে।‘ ডনি মাঝে মাঝে তাকে প্রায় পছন্দ করে ফেলে। নোংরাভাবে ধনী হওয়ার বাসনার ব্যাপারে সে এত খোলাখুলি বলে। কিছু কিছু কোটিপতির ছেলে আছে, যারা বিজ্ঞানী অথবা স্বল্প বেতনের অন্য কিছু হওয়ার ভান করে, তাদের মতো তার কোনও ভণ্ডামি নেই।

মন্টি এখন ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। মশার কামড়ের জায়গাগুলো চুলকাচ্ছে। ফিসফিস করে বলে, ‘এই ফিনলি।‘

ডনি বলে, ‘ঘুমা গিয়ে।‘

‘আমি বাজি ধরতে পারি তাদের কাছে ফ্ল্যাস্ক আছে।‘

‘কী?’

‘বাজি ধরছি তারা পান করছে। গতকাল পেরির নিঃশ্বাসে আমি গন্ধ পেয়েছিলাম।‘

ডনি বলে, ‘তাতে কী?’

মন্টি বলে, ‘তাতে এটা নিয়মের বিরুদ্ধে যায়। তাদের কাছ থেকে আমরাও হয়ত কিছু পেতে পারি।‘

মন্টিকে এটা হাতে হাতে দিতে হবে ডনির। সে নিশ্চয়ই কোণা-কাঞ্চিগুলো জানে। অন্ততপক্ষে তারা সম্পদ ভাগ করে নিতে পারবে।

ঘুমানোর থলে থেকে একটু একটু করে বের হয়ে তারা আগুনটার পিছনে নিচু হয়ে গোল হয়। পরিচারিকাদের গুপ্তচরবৃত্তি করার সময় এ চর্চাটা তাদের ভালোই কাজে দেয়। কান টান টান করে, বোতলের রূপরেখা কিংবা উত্তোলিত কনুই দেখতে তারা ঝোপ-ঝাড়ের পিছনে গুঁটিসুঁটি মেরে থাকে।

কিন্তু তারা যা শুনতে পায় সেটা মদ সম্পর্কে নয়, রনেট সম্পর্কে। ডার্স তার সম্পর্কে এমনভাবে কথা বলছে যেন রনেট এক টুকরো মাংস। ডার্স যা ইঙ্গিত দিচ্ছে তা থেকে এটা দাঁড়ায় যে, ডার্স যা চায় রনেট তা-ই করতে দেয়। ডার্স তাকে ‘গ্রীষ্মকালীন চাটনি’ বলে। এই অভিব্যক্তিটা ডনি আগে কখনও শোনেনি। তাই সাধারণভাবে সে মনে করে এটা হাসির কিছু হবে।


৩য় পর্ব                                                                                                              ৫ম পর্ব

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*