ট্রু ট্রাশ – অনুবাদ

গল্প

ট্রু ট্রাশ

ট্রু ট্রাশ

মূল: মার্গারেট এটউড

অনুবাদ: সেলিম মিয়া


মন্টি চাপা হাসি হেসে ডনির পাঁজরে কনুই দিয়ে গুঁতা মারে। মন্টি কি জানে এতে কতটা লাগে? সে কি বিষয়টা মনে করিয়ে দিচ্ছে? ডনি রনেটকে ভালোবাসে।  কাউকে ভালোবাসার অভিযোগে অভিযুক্ত হওয়া চূড়ান্তভাবে ষষ্ট গ্রেডের অপমান। ডনি মনে করে এটা যেন সে নিজেই, যার নামে কথা রটেছে, যার মুখে কালি লেগেছে। সে জানে মন্টি অন্য ছেলেদের কাছে এসব কথাবার্তা বলে দেবে। বলবে ডার্স রনেটের সাথে শূকরামি(যৌন-সংসর্গ) করছে। ডনির এখন এই শব্দটাতে অরুচিতে এসে গেছে। শব্দটা ঘোঁৎ ঘোঁৎ করা দুটো শূকরের কথা মনে করিয়ে দেয়। অথবা মনে করিয়ে দেয় রবিবারের দুটো মৃত অথচ প্রাণবন্ত অসিদ্ধ রোস্টের কথা। যদিও এই তো গতকাকালকেই সে নিজে এটা ব্যবহার করে যথেষ্ট মজা পেয়েছিল।

ঝোপ থেকে বের হয়ে তার পক্ষে ডার্সের নাকে ঘুষি মারা যায় না বললেই চলে। মারতে পারলে ডার্সকে শুধু হাস্যকরই দেখাত না, তাকে ধরাশায়িও করা যেত।

সে যেটুকু চিন্তা করতে পারে, সেটুকুই করে। পরের দিন সকালে তারা যখন ক্যাম্পটা তুলে নিচ্ছে, সে তখন মন্টির বাইনোকুলারটা চুরি করে লেকে ডুবিয়ে রাখে।

মন্টি বিষয়টা আন্দাজ করে তাকে অভিযুক্ত করে। এক ধরণের অহংকার ডনিকে তা অস্বীকার করতে নিবৃত্ত করে। সে বলতেও পারে না কেন সে কাজটা করেছিল। তাদের দ্বীপে ফেরার সময় ডাইনিং হলে খ সাহেবের সাথে অশোভন কথাবার্তা চলছে। অথবা ঠিক কথাবার্তা না: খ সাহেব কথা বলছেন, আর ডনি চুপচাপ। সে খ সাহেবের দিকে তাকায় না, তবে দেয়ালে পাইক মাছের মাথার দিকে চোখ পাকিয়ে তাকায়।

পরের বার মেহগনির লঞ্চটি শহরে ফিরে যায়। তার বাবা-মা সন্তুষ্ট হয় না।

গ্রীষ্মের শেষ। ক্যাম্পাররা ইতোমধ্যে চলে গেছে। যদিও কাউন্সেলরদের কেউ কেউ এবং পরিচারিকারা এখনও রয়ে গেছে। আগামীকাল তারা মূল ডকে চলে যাবে, ধীর গতির লঞ্চটাতে চড়বে, শীতকে বরণ করতে উদ্যত গোলাপি দ্বীপগুলোর মধ্য দিয়ে যাবে।

জোয়ানের অর্ধেক দিন ছুটি। তাই ডাইনিং হলে অন্যদের সাথে বাসন-কোসন ধুচ্ছে না। ক্যাবিনে মালপত্র গোছাচ্ছে। ডাফল ব্যাগটা ভরানো হয়ে গেছে। ভরানো শেষে তার বিছানার সাথে হেলান দিয়ে রেখেছে। এখন ছোট স্যূটকেসটা ভরাচ্ছে। তার পে-চেকটা ইতোমধ্যে ভেতরে গুঁজিয়ে রাখা হয়েছে: দু’শ ডলার, অনেক টাকা।

এখনও ইউনিফর্ম পরা অবস্থায় রনেট ক্যাবিনের স্ক্রীন দরজাটা আস্তে করে বন্ধ করে জোয়ানের পিছনে আসে। জোয়ানের বিছানায় বসে সিগারেট ধরায়। জোয়ান ভাঁজ পড়া সূতির পায়জামা পরে সেখানে দাঁড়িয়ে আছে। সতর্ক যেন কিছু একটা ঘটছে। রনেট সম্প্রতি তার আগেকার স্বল্পভাষী মেজাজে ফিরে এসেছে। হাসেই না প্রায়। কাউন্সেলরদের বিনোদন হলে ডার্স আবারও গান বাজাচ্ছে। হিলারির চারপাশে ঘুরছে। হিলারি রনেটকে বিবেচনায় রেখে না দেখার ভান করছে। জোয়ান হয়ত এখন শুনতে পাবে বড় ধরণের ভাঙনের কারণটা কী ছিল। রনেট এতক্ষণ এ ব্যাপারে কিছু বলেনি।

কপালে এসে পড়া লম্বা হলুদ চুলের মধ্য দিয়ে রনেট জোয়ানের দিকে মুখ তুলে চায়। এমনভাবে চায় যে, লাল লিপস্টিক সত্ত্বেও তাকে আরও তরুণী মনে হয়। সে বলে, ‘সমস্যায় আছি আমি।‘

জোয়ান বলে, ‘কী ধরণের সমস্যা?’ ধোঁয়া উড়িয়ে রনেট বিষাদের হাসি হাসে। এখন তাকে বয়স্ক দেখাচ্ছে। ‘তুই জানিস। সমস্যা।‘

জোয়ান বলে, ‘তাই?’ রনেটের পাশে বসে পায়জামাটা আলিঙ্গন করে। ঠাণ্ডা বোধ করে সে। ডার্সই হবে। যৌন-আবেদনময়ী সঙ্গীতে ধরা খেয়েছে। রনেটকে এখন তার বিয়ে করতে হবে। অথবা অন্য কিছু করতে হবে। ‘তুই কী করবি এখন?’

রনেট বলে, ‘জানি না। বলিস না, ঠিক আছে? কাউকে বলিস না।‘

জোয়ান বলে, ‘তাকে বলবি না?’ রনেট এমনটা করবে এটা সে কল্পনাও করতে পারছে না। এর কোনও কিছুই কল্পনা করতে পারছে না।

রনেট বলে, ‘কাকে বলব?’

‘ডার্সকে।‘

আরও ধোঁয়া ছাড়ে রনেট, আর বলে, ‘ডার্স, মুরগির উচ্ছিষ্ট সাহেব। এটা তো সে না।‘

জোয়ান অবাক হয় এবং স্বস্থি বোধ করে। কিন্তু নিজের প্রতি বিরক্তও হয়। তার কী হয়েছে? কী বাদ গেছে? ‘ডার্স নয়? তাহলে কে?’

কিন্তু বিশ্বাস করে কিছু বলার ব্যাপারে রনেটের মন আপাতত পাল্টে গেছে। হাসার চেষ্টা করে সে বলে, ‘সেটা আমার জানার বিষয়; তোর খুঁজে বের করার বিষয়।‘

জোয়ান বলে, ‘আচ্ছা।‘  তার হাতদুটো ভিজে আছে যেন তার সে-ই যেন সমস্যায় আছে। সে সাহায্য করতে চায়। কিন্তু কীভাবে করবে সে ব্যাপারে তার কোনও ধারণা নেই। ‘জানি না— তুই ইয়া করতে পারিস।‘ সে জানে না। গর্ভপাত? এ শব্দটা তো রাষ্ট্রের সাথে সম্পৃক্ত অন্ধকার ও রহস্যের শব্দ। তোমাকে চলে যেতে হবে। এতে অনেক খরচ। অবিবাহিত মায়েদের জন্য বাসা? তারপর দত্তক দেওয়া? তার শুধু ক্ষতিই হবে। রনেটের ভবিষ্যৎ দেখতে পায় সে—স্বীকৃতি পাচ্ছে না, ভরাডুবি হবে, নিজের শরীরে বন্দী করা উৎসর্গ সম্প্রদান করতে হবে। কোনও না কোনওভাবে কৃচ্ছতাসাধন করতে হবে, কলঙ্কিত হতে হবে, বন্দী জীবন কাটাতে হবে। এ অবস্থাটা সন্নাসিনীর মতো কিছু একটা। সপ্রংশস ভীতি জাগে তার মধ্যে। যদিও তার যা মনে হচ্ছে, মোটেও তা নয়, তবুও সে বলে, ‘আমার মনে হয় কোনও না কোনওভাবে তুই এর থেকে মুক্তি পেতে পারিস।‘ জন্মিলে মরিতে হবে।

এক ধরণের অবজ্ঞা নিয়ে রনেট বলে, ‘ফাইজলামি করছিস? কসম, আমি না।‘ সিগারেটটা মেঝেতে ফেলে দিয়ে হিল দিয়ে গুঁড়া করে। ‘আমি রাখব। ভাবিস না, মা আমাকে সাহায্য করবে।‘

জোয়ান বলে, ‘হুম।‘ এখন সে তার দম ফিরে পায়। এখন সে ভাবতে শুরু করে রনেট কেন এসব কিছু নিজের মধ্যে রেখে দিয়েছে, বিশেষ করে পুরো বিষয়টা যখন বলতে চায় না। প্রতারিত ও গায়ে পড়ে কথা বলার বোধ হতে শুরু করছে তার। তা লোকটা কে? তাদের মধ্যে কোন জন? কাউন্সেলরদের মুখগুলো খুঁজতে থাকে সে। কোনও ইঙ্গিত, অপরাধ বোধের চিহ্ন মনে করার চেষ্টা করে, কিন্তু কিছুই খুঁজে পায় না।

রনেট বলে, ‘যাই হোক, আমাকে আর স্কুলে ফিরে যেতে হবে না। তারা যেমন বলে তেমন করে বলতে হয়, ছোট-খাটো ক্ষমার জন্য ঈশ্বরকে ধন্যবাদ।‘

মিথ্যে প্রবোধ ও একাকীত্বের কথা শুনতে পায় জোয়ান। হাত বাড়িয়ে দিয়ে রনেটের বাহুতে মৃদু একটা চাপ দেয়। বলে, ‘ভাগ্য সুপ্রসন্ন হোক।‘  পরীক্ষা, প্রতিযোগিতা কিংবা যুদ্ধের আগে আপনি যেমন বলেন, এটা অনেকটা সে রকম শোনাচ্ছে। নির্বোধের মতো শোনাচ্ছে।

রনেট দাঁত চেপে হাসে। তার দাঁতের ফাঁকা জায়গাগুলো এক পাশে দেখা যায়। সে বলে, ‘তোমারও ভাগ্য সুপ্রসন্ন হোক।‘

***

এগারো বছর পরে গ্রীষ্মের গরমের মধ্যে ডনি টরন্টোর ইয়র্কভিল অ্যাভিনিউ ধরে হাঁটছে। এখন আর সে ডনি নয়। কোন সময় যে ডন হয়েছে তা সেও ঠিক মনে করতে পারে না। স্যান্ডেল এবং ছেঁড়া জিন্সের ওপর ইন্ডিয়ান স্টাইলে সাদা শার্ট পরে আছে। খানিকটা লম্বা চুল ও দাঁড়ি রেখে দিয়েছে। দাঁড়িটা হলদে, আর চুলগুলো বাদামি। মেজাজের ওপর নির্ভর করে সে ওয়োস্প জিজাজ কিংবা হলিউড ভাইকিংয়ের বেশ পছন্দ করে। গলায় পরে আছে কাঠের একগুচ্ছ পুঁতি।

শনিবার করে এভাবে সেজেই সে ইয়র্কভিলে যায়। ভিড়ের মধ্যে তার মতো অনেকের সাথে ঘুরে বেড়ায়। এক কালের সিগারেটের মতো সহজলভ্য গাঁজা খেয়ে বুঁদ হয়ে পড়ে থাকে। সে মনে করে এই অভিজ্ঞতা যতটা না সে আসলে উপভোগ করে তার চেয়ে আরও বেশি করা উচিৎ।

বাকি সপ্তাহে সে তার বাবার আইন অফিসে কাজ করে। সেখানে দাঁড়িটার একটা ব্যবস্থা সে করতে পারে যতক্ষণ সে এটার সাথে স্যূট মানিয়ে পরে। (কিন্তু বয়স্কদেরও জুলফি বড় হচ্ছে, তারা রঙিন শার্ট পরছে, আর যতটা না অভ্যস্ত তার চেয়ে বেশি করে ‘সৃজনশীল’ এর মতো শব্দ ব্যবহার করছে।) ইয়র্কভিলে যত লোকের সাথে তার দেখা হয় তাদেরকে চাকুরিটার ব্যাপারে সে কিছু বলে না, যেমনটা তার বন্ধুদের এসিড যাত্রা সম্পর্কে আইন অফিসকে বলে না। দ্বৈত জীবন কাটাচ্ছে সে। এটাকে বিপজ্জনক ও সাহসী মনে হয়।

রাস্তার ওপাশে হঠাৎ করে সে জোয়ানকে দেখে। অনেক দিন জোয়ানের ব্যাপারে সে কিছু ভাবেওনি। কিন্তু এ তো সে-ই। ইউর্কভিল মেয়েদের টাই-ডাই করা কিংবা সাধারণ ইউনিফর্ম পরেনি সে। তার বদলে স্যূট-জ্যাকেটের সাথে মানিয়ে ভাবগম্ভীর সাদা মিনি-স্কার্ট পরে আছে। ব্রিফকেস হাতে ঝুলিয়ে এবং লম্বা লম্বা পা ফেলে সে এমনভাবে যাচ্ছে যেন তার একটা উদ্দেশ্য আছে। এটাই তাকে অনন্য করে তুলেছে। এখানে গৃহীত হাঁটাটা হলো ধীরে সুস্থে হাঁটা।

রাস্তার ওপাশে এক দৌড়ে গিয়ে তাকে পাকড়াও করবে কিনা, নিজেকে যেভাবে ভাবে সেই সত্যিকার অথচ গোপন পরিচয়টা প্রকাশ করে দেবে কিনা রনি তা ভেবে পায় না। এখন জোয়ানের যতটুকু দেখা যাচ্ছে তা হলো তার পিঠ। এক মিনিটের মধ্যে সে নাই হয়ে যাবে।

ডনি ডাকে, ‘জোয়ান।‘ জোয়ান রনির ডাক শুনতে পায় না। গাড়িগুলো কেটে গিয়ে সে তার নাগালে পৌঁছায় এবং তার কনুই ধরে। বলে, ‘ডন ফিনলে।‘ সেখানে দাঁড়িয়েও সে নিজের ব্যাপারে সচেতন থাকে। বোকার মতো দাঁত বের করে হাসে। সৌভাগ্যবশত এবং একটু হতাশজনকভাবে জোয়ান ডনিকে সঙ্গে সঙ্গে চিনে ফেলে।

জোয়ান বলে, ‘ডনি! হায় ঈশ্বর, তুমি তো বড় হয়ে গেছ!’

শিশুর মতো, বোকার মতো ডনি বলে, ‘তোমার চেয়ে তো লম্বা আমি।‘

জোয়ান হেসে বলে, ‘তখন ছিলে। আমি বলতে চাচ্ছি তুমি বড় হয়ে গেছ।‘

ডনি বলে, ‘তুমিও হয়েছ।‘ আর তারা প্রায় সমবয়সীদের মতো হেসে ওঠে। তাদের মধ্যে তিন, চার বছরের পার্থক্য। সে সময় এটা খুব বড় একটা পার্থক্য ছিল। এখন কিছুই না।

জোয়ান তাই ভাবে, ডনি আর ডনি নেই। এর মানে দাঁড়ায় রিচি এখন রিচার্ড। মন্টির তো শুধু ইনিশিয়াল আছে, আর অঢেল টাকা আছে। সত্য, সে কিছু টাকা উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছে। কিন্তু সে সেটাকে সুযোগমতো কাজে লাগিয়েছে। ব্যবসার কাগজ-পত্রে জোয়ান মাঝে মাঝে ডনির কাজ-কর্ম ঠিক করে দিয়েছে। আর ডনি হিলারিকে তিন বছর আগে বিয়ে করেছে। ভাবুন তো। জোয়ান সেটাও কাগজে দেখেছে।

তারা কফি খেতে যায়। বিশাল, উজ্জ্বলভাবে চিত্রিত কাঠের একটা তোতা পাখির নিচে নতুন, ঝুঁকিপূর্ণ বাইরের টেবিলে গিয়ে বসে। তাদের মধ্যে সখ্য আছে, যেন পুরাতন বন্ধু। ডনি জোয়ানকে জিজ্ঞেস করে সে কী করছে। জোয়ান বলে, ‘বুদ্ধি বেঁচে খাই। ফ্রিল্যান্সিং করি।‘ এ মুহূর্তে সে অ্যাড কপি লিখছে। তার মুখমণ্ডল আরও চিকন হয়ে গেছে। বয়ঃসন্ধিকালের সেই গোলগাল ভাবটা হারিয়ে ফেলেছে। তার এক সময়কার নিস্তেজ চুলগুলো স্টাইলিশ হয়েছে। পাদুটোও যথেষ্ট ভালো হয়েছে। মিনি স্কার্ট পরতে হলে ভালো পা থাকতে হয়। তাই অনেক মেয়েকেই ওটা পরলে বেঁটে ও মোটা লাগে। উরুর পিছন দিকটা কাপড়ের মধ্যে ঢুকে যায়। সাদা রুটির টুকরোর মতো তাদের পাগুলো নিতম্বকে স্ফীত করে তোলে। টেবিলের নিচে জোয়ানের পা দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু ডনি যেন পাগুলো নিয়ে কথা বলতে চায়। আগে যখন জোয়ানের পাগুলো পরিচারিকাদের ডকে পুরোপুরি দৃশ্যমান ছিল, তখন সে কখনও সেগুলো নিয়ে কথা বলেনি। সে সময় ঐ পাগুলো হালকা চোখে দেখত। সব মিলিয়ে জোয়ানকেও হালকাভাবে দেখত। রনেটই ডনির মনোযোগ আকর্ষণ করেছিল। ডনি এখন আরও বেশি সমঝধার।

সে বলে, ‘তোমাদের ওপর গুপ্তচরবৃত্তি করতাম। তোমাদের কাপড় ছাড়া সাঁতার কাটা দেখতাম।‘ তারা আসলে তেমন কিছু কখনও দেখতে পায়নি। মেয়েরা শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তোয়ালে দিয়ে তাদের শরীর ঢেকে রাখত। তাছাড়া, তখন সময়টা ছিল গোধূলি বেলা। সাদাটে ঝাপসা ভাব ছিল। কিছুটা চিৎকার-চেঁচামেচি ও কিছুটা জল-ছিটা থাকত। বড় বিষয়টা হত গোপনাঙ্গের চুল নিয়ে। কিছু কিছু ছেলের দাবি ছিল তারা দেখেছে। কিন্তু ডনির মনে হয়েছিল তারা মিথ্যে বলছে। নাকি সেটা শুধুই ঈর্ষা ছিল?

অন্যমনস্ক হয়ে জোয়ান বলে, ‘দেখেছিলে নাকি তুমি? আমি জানি আমরা তখন আশপাশের ঝোঁপগুলো নড়তে দেখতাম। আমরা ভাবতাম কতই না মজার।‘

লজ্জা পেয়ে ডনির মুখ লাল হয়ে আসে। খুশি হয় যে, তার দাঁড়ি আছে। দাঁড়িগুলো সব কিছু গোপন করে রাখছে। সে বলে, ‘মজার না। আসলে আমরা খুব দুষ্টু ছিলাম।‘ শূকরামি (যৌন-সংসর্গ) শব্দটা তার মনে পড়ছে। ‘অন্যদের সাথে দেখা হয় তোমার?’

জোয়ান বলে, ‘আর দেখা হয় না। বিশ্ববিদ্যালয়ে কারও কারও সাথে হয়েছিল। হিলারি আর অ্যালেক্সের সাথে। মাঝে-মধ্যে প্যাটের সাথে।‘

ডনি বলে, ‘রনেটের সাথে দেখা হয় না?’ শুধু এটাই সে জিজ্ঞেস করতে চায়।

ডনির কথা জোয়ান যেন শুনতেই পায়নি। তাই বলে, ‘ডার্সের সাথে দেখা হত।‘

দেখা হত কথাটা বাড়িয়ে বলা কথা। জোয়ান ডার্সকে একবারই দেখেছিল।

ফেব্রুয়ারির শীত ছিল। ডার্স জোয়ানকে বিশ্ববিদ্যালয় অফিসে ফোন দিয়েছিল। ডার্স সেভাবেই জেনেছিল জোয়ানকে কোথায় পাওয়া যাবে। ক্যাম্পাসের পত্রিকায় সে তার নাম দেখেছিল। সে সময় নাগাদ ডার্সের কথা জোয়ানের প্রায় মনেই ছিল না। যে গ্রীষ্মে সে পরিচারিকার কাজ করেছিল, সে গ্রীষ্মের তিন বছর হয়ে গিয়েছিল, আলোকবর্ষ দূরত্বের হয়ে গিয়েছিল। ট্রেনের বাবুর্চি ছেলেবন্ধুটিও অনেক আগে চলে গিয়েছিল। তার মতো এত নিস্পাপ আর কেউ তার জায়গাটা নিতে পারেনি। জোয়ান তখন আর হরিণের চামড়া দিয়ে তৈরি সাদা জুতা পরত না। গানও গাইত না আর। সে পরত কচ্ছপ-গলাবিশিষ্ট পোশাক। পান করত বিয়ার এবং প্রচুর কফি। আর ক্যাম্পাসের ডাইনিংয়ের সুযোগ-সুবিধার মতো বিষয়াদি নিয়ে সংশয়বাদী প্রতিবেদন লিখত। সে অবশ্য অল্প বয়সে মরে যাওয়ার ধারণাটা ত্যাগ করেছিল। এ সময়ের মধ্যে এটা অত্যন্ত রোমান্টিক মনে হয়েছিল।

ডার্স যেটা চেয়েছিল সেটা ছিল জোয়ানের সাথে বাইরে যাওয়া। বিশেষ করে, সে চেয়েছিল তার সাথে জোয়ান যেন ফ্র্যাটারনিটি ক্লাবে যায়। জোয়ান এত অবাক হয়েছিল যে সে হ্যাঁ বলেছিল, যদিও যেসব লোকের সাথে তখন সে ভ্রমণে যেত তাদের জন্য ফ্র্যাটারনিটি ক্লাব রাজনৈতিকভাবে পক্ষে ছিল না। এটা এমন কিছু ছিল যা তাকে গোপনে করতে হত। আর তা-ই করেছিল সে। অবশ্য রুমমেটের কাছ থেকে একটা ড্রেস ধার করতে হয়েছিল তার। পার্টিটা ছিল সেমি-ফর্মাল। তাছাড়া হাই স্কুলের পর থেকে সে এমন পার্টিতে যাওয়ার কোনও পরিকল্পনা করেনি।

ডার্সকে সে শেষ দেখেছিল রৌদ্র-মলিন চুলে ও সুগভীর দীপ্তিময় তামাটে ত্বকে। আর শীতের ত্বকে তাকে দেখাচ্ছিল মলিন ও অপুষ্ট। এছাড়া সে কারও সাথে আর ফষ্টিনষ্টিও করত না। জোয়ানের সাথেও না। তার বদলে সে জোয়ানকে আরও কিছু দম্পতির সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল, তার সাথে মেঝেতে দায়সারা নাচ নেচেছিল এবং আঙুর রস ও সরাসরি অ্যালকোহলের মিশ্রণ পান করে বদ্ধ মাতাল হতে লেগেছিল। ফ্র্যাটারনিটি ক্লাবের ভ্রাতৃবৃন্দ এ মিশ্রণকে বলত বেগুনি ঈশা। ডার্স জোয়ানকে বলেছিল যে, ছয় মাসেরও বেশি হল হিলারির সাথে তার ইনগেজমেন্ট হয়েছে। কিন্তু হিলারি তাকে ত্যাগ করেছিল। কেন করেছিল সেটাও বলেনি। ডার্স বলেছিল যে, সে ডেটিংয়ের জন্য জোয়ানকে বাইরে যেতে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল, কারণ জোয়ান সে রকম মেয়েই ছিল যার সাথে কথা বলা যায়। ডার্স জানত জোয়ান বুঝবে। তারপর ডার্স প্রচুর বেগুনি ঈশা উদগীরণ করেছিল, প্রথমে জোয়ানের পোশাকে, তারপর জোয়ান তাকে বাইরে নিয়ে গেলে তুষারস্তূপের বারান্দায়। বর্ণক্রম ছিল আশ্চর্যজনক।

জোয়ান তাকে কিছুটা কফি পান করিয়েছিলে, আর গাড়িতে করে বাসায় পৌঁছে দিয়েছিল। সেখানে বরফি আগুন এড়াতে জানালা দিয়ে ঢুকেছিল, কারণ তখন সময়টা স্বাভাবিক সময়ের বাইরে ছিল।

জোয়ান আহত হয়েছিল। শুধু কথা শোনা ছাড়া ডার্সের জন্য কিছুই করার ছিল না তার। বিরক্তও হয়েছিল সে। যে ড্রেসটা সে ধার করে এনেছিল সেটার রঙ ছিল হালকা নীল। আর কেবল পানিতে বেগুনি ঈশা যাবে না। সেন্ট জুডে শেখানো আচরণ অনুযায়ী পরের দিন ডার্স ক্ষমা চাওয়ার জন্য ডেকেছিল। আর জোয়ান তার হাতে পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতার একটা বিল ধরিয়ে দিয়েছিল। যদিও হালকা দাগ ছিল।

ডার্সের টালমাতাল হাঁটা ও জড়িয়ে জড়িয়ে কথা বলার শুরুর আগে, যখন তারা নাচছিল, জোয়ান তখন বলেছিল, ‘রনেটের কোনও খবর জানো?’ বর্ণনা দেওয়ার অভ্যাসটা তখনও জোয়ানের ছিল। তখনও সে গল্পের শেষটা জানতে আগ্রহী ছিল। কিন্তু ডার্স তার দিকে পুরোপুরি ভ্যাবাচ্যাকা হয়ে তাকিয়েছিল।

ডার্স বলেছিল, ‘কে?’ প্রশ্নটা করা তার বোকামি ছিল না। আসলেই মনে ছিল না তার। তার স্মৃতিতে এই ফাঁকা স্থানটাকে জোয়ানের কাছে আঘাতজনক লেগেছিল। জোয়ান না হয় নাম ভুলে যেতে পারে, ভুলে যেতে পারে মুখও। কিন্তু শরীর? যে শরীর আপনার নিজের এত কাছের, যে শরীরে ঐসব গুঞ্জন তৈরি হয়েছে, অন্ধকারে ঐসব খসখস শব্দ হয়েছে, ঐ তীব্র ব্যথা হয়েছে, তার নিজেরটাসহ সেই শরীরের জন্য এটা তো অপমানজনক।


৪র্থ পর্ব                                                                                                            শেষ পর্ব

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*