ট্রু ট্রাশ – অনুবাদ

গল্প

ট্রু ট্রাশ

ট্রু ট্রাশ

মূল: মার্গারেট এটউড

অনুবাদ: সেলিম মিয়া


খ সাহেব ও পাইক মাছের মাথার সাথে সাক্ষাৎ হওয়ার পর ডনি হেঁটে ছোট্ট বেলাভূমিটিতে যায়। সেখানে সে কাপড় ধোঁয়া-কাচার কাজটি সেরে নেয়। তার ক্যাবিনের বাকি সবাই নৌকা বাইতে গেছে। তবে ক্যাম্প রুটিন থেকে সে এখন মুক্ত। তাকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। অসম্মানজনক অব্যাহতি। সাতটি গ্রীষ্মকাল এখানে আদেশ-অধীন থাকার পর সে যা চায় তা-ই করতে পারে। সেটা কী হতে পারে সে সম্পর্কে তার কোনও ধারণা নেই।

বালুতে পা রেখে গোলাপি শিলার স্ফীত জায়গায় সে বসে পড়ে। তার হাতের কাছে শিলা পার হয়ে যায় একটা টিকটিকি। তবে খুব দ্রুত পার হয় না। টিকটিকিটা তাকে দেখেনি। এর লেজটা নীল রঙের, আর ধরলেই খসে পড়বে। তারা বলে, স্কিঙ্ক। এক সময় এটা জেনে সে মজা পেয়েছিল। ঢেউ আছড়ে পড়ে পিছে সরে যাচ্ছে। পরিচিত হৃদস্পন্দন। চোখ বন্ধ করে সে শুধু যন্ত্রের শব্দ শুনতে পায়। সম্ভবত সে খুব রেগে আছে, না হয় মন খারাপ করে আছে। সে তা জানে না বললেই চলে।

কোনও কিছু না বলে রনেট সেখানে এসে হাজির। গাছগুলোর মধ্য দিয়ে নিচে নেমে সে ডনির পিছনে এসে আছে। রনেট এখনও ইউনিফর্ম পরে আছে, যদিও সময়টা ডিনারের কাছাকাছি সময় না। কেবল পড়ন্ত বিকেল। এ সময় পরিচারিকারা সাধারণত তাদের ডক ছেড়ে কাপড় বদল করতে চলে যায়।

ডনির পাশে এসে বসে রনেট। অ্যাপ্রোনের নিচে গোপন পকেট থেকে সিগারেট বের করে, আর বলে, ‘সিগারেট লাগবে?’

একটা সিগারেট নিয়ে ডনি বলে, ‘তোমাকে ধন্যবাদ।‘ধন্যবাদ না। ছায়াছবিতে চামড়ার জ্যাকেট পরা লোকদের মতো নির্বাকভাবে না, তবে সেন্ট জুডের ভালো ছেলের মতো ‘তোমাকে ধন্যবাদ’। ডনি তাকে সিগারেটটা জ্বালাতে দেয়। আর কীই-বা করতে পারে সে? জোয়ানের কাছে দিয়াশলাই আছে। ডনি সন্তর্পণে টান দেয়। সে তো আসলেই খুব একটা ধূমপান করে না। আর কাশির ভয় তো আছেই।

ডনি বলে, ‘ঠিক আছে। আমি পরোয়া করি না।‘ সে তো বলতে পারছে না কেন, কতটা ভালো হয়েছে সে। তবে আশা রাখে তার কান্না পাবে না।

জোয়ান বলে, ‘শুনলাম তুমি নাকি মন্টির বাইনোকুলারটা লেকে ফেলে দিয়েছ।‘

ডনি কেবল সম্মতিসূচক মাথা নাড়াতে পারে। সে জোয়ানের দিকে তাকায়। জোয়ান হাসছে। তার মুখের পাশে হৃদয়-ভাঙ্গা জায়গাটা ডনি দেখতে পাচ্ছে। হারানো দাঁতের ফাঁকা জায়গাটা। জোয়ানের মনে হয় ডনি মজার মানুষ।

জোয়ান বলে, ‘আচ্ছা, আমি তোমার সাথে আছি। তাকে কিন্তু আমার অপছন্দ হয়।‘

স্বীকার করার কিংবা সিরিয়াস হওয়ার গরজ তাড়িত হয়ে ডনি বলে, ‘তার জন্য এটা ফেলে দেওয়া হয়নি। ডার্সের জন্য হয়েছিল।‘ ঘুরে গিয়ে এই প্রথম বারের মতো সে জোয়ানের চোখে সরাসরি তাকায়। চোখগুলো এত সবুজ। ডনির হাতদুটো এখন কাঁপছে। সিগারেটটা তার হাত থেকে বালুতে পড়ে যায়। সে চলে যাওয়ার পর তারা কাল মোথাটা খুঁজে পাবে। খুঁজে পাবে রনেটকে ফেলে চলে যাওয়ার পর অন্যদের কথার বদৌলতে। ‘তোমার জন্যই এসব হলো। তোমাকে নিয়ে তারা যা বলছিল। ডার্সেই ছিল।‘

রনেটের মুখে হাসি নেই আর। সে বলে, ‘যেমন—‘

ডনি বলে, ‘বাদ দাও। তোমার জানার ইচ্ছে নেই।‘

রনেট বলে, ‘যেমন করেই হোক সেই বালটা আমি জানি।‘ না রেগে সে বরং মেনে নেয় মনে হল। উঠে দাঁড়িয়ে পিছনে দু’হাত রাখে। ডনির বুঝতে এক মুহূর্ত লাগে যে, রনেট তার অ্যাপ্রোন খুলছে। খুলে ডনির হাত ধরে এবং আলগোছে টান দেয়। শিলাপাহাড়ের চারদিকে ঘুরিয়ে এমন জায়গায় নিয়ে যায় যেখানে পানি ছাড়া আর অন্য কিছু দেখা যায় না। নিজের হাত প্রসারিত করে ডনির হাতদুটো ঠিক করে রনেট। তারপর বসে, শোয়, হাসে। তার নীল রঙা ইউনিফর্মটার বোতাম খুলে গিয়ে সামনে পড়ে যায়। ডনির বিশ্বাস হয় না যে, প্রকাশ্য দিবালোকে তার সাথে এটা ঘটতে যাচ্ছে। ঠিক ঘুমের মধ্যে হাঁটার মতো, খুব দ্রুত দৌড়ানোর মতো, অন্য কিছুর মতো না।

জোয়ান বলে, ‘আরেকটা কফি খাবে?’ পরিচারিকাকে সে সম্মতিসূচক মাথা নেড়ে ঈশারা করে। ডনি যদিও তার কথা শুনতে পায়নি।

সে বলছে, ‘আমার সাথে সে কিন্তু সুন্দর ব্যবহার করত। রনেট। তুমি তো জানো খ সাহেব আমাকে তাড়িয়েছে। সেই সময়ে আমার কাছে ওটাই অনেক কিছু ছিল।‘ ডনি অপরাধ বোধে ভুগছে। কারণ সে রনেটকে কখনও কিছু লেখেনি। ডনি জানতও না সে কোথায় থাকত। কিন্তু তাকে খুঁজে বের করার কোনও পদক্ষেপও নেয়নি সে। এছাড়া, না ভেবে সে থাকতে পারত না: ওরাই ঠিক বলেছে। সে একটা বেশ্যা। রনেট যা করেছিল ডনি তাতে গভীর আঘাত পেয়েছিল। এর জন্য সে প্রস্তুত ছিল না।

মুখ কিছুটা হা করে জোয়ান ডনির দিকে এমনভাবে তাকিয়ে আছে যেন সে কথা বলা কুকুর, কথা বলা পাথর। নার্ভাস হয়ে ডনি আঙুল দিয়ে তার দাঁড়ি বোলায়, আর ভাবে সে যা বলেছে তা কি ভুল নাকি বেঁফাস কথা।

গল্পের শেষটা কিংবা এক গল্পের একটা শেষ সবেমাত্র দেখেছে জোয়ান। অথবা নিদেনপক্ষে বাদ দেওয়া অংশটুকু। রনেট তাই বলত না: ডনিই ছিল সে। রনেট তাকে বাঁচিয়ে দিত। অথবা হয়ত নিজেকে বাঁচাত। চৌদ্দ বছরের এক ছেলে। হাস্যকর।

তখন যা হাস্যকর ছিল এখন তা সম্ভব। এখন যে কোনও কিছু করা যায়। আর এতে কেউ আঘাত পাবে না। শুধু একটু মাথা নাড়ানি। সব কিছুই চমৎকার। একটা রেখা টানা হয়েছে যার অপর প্রান্তে আছে অতীত। বর্তমানের চেয়ে যা আরও অন্ধকারাচ্ছন্ন এবং আরও বেশি উজ্জ্বলভাবে তীব্র।

রেখা বরাবর তাকিয়ে জোয়ান দেখে গোসলের পোশাকে নয় জন পরিচারিকাকে। পরিষ্কার জ্বলন্ত সূর্যালোকে তারা ডকে হাসাহাসি করছে। তাদের মধ্যে সেও আছে। আর বেলাভূমির খসখস আওয়াজ করা ছায়াময় ঝোঁপের দূরবর্তী প্রান্তে বিপজ্জনকভাবে যৌনতা ওঁৎ পেতে আছে। তখন এটা বিপজ্জনক ছিল। পাপ ছিল। নিষিদ্ধ, গোপন, কলঙ্কময় ছিল। কামনায় কাতর ছিল। তিনটি ফোঁটাতেই তা নিখুঁতভাবে প্রকাশ পেয়েছে। কারণ এর জন্য কোনও সাধারণ শব্দ ছিল না।

অন্যদিকে ছিল বিয়ে, যার মানে ছিল স্ত্রীদের কাছ থেকে প্রত্যাশিত চেকের অ্যাপ্রোন, বাচ্চাদের খেলার জন্য জাল বা কাঠের খাট, মধুর নিরাপত্তা।

কিন্তু কোনও কিছুই সেভাবে হয়নি। যৌনতাকে পোষ মানানো হয়েছে, প্রতিশ্রুত রহস্যকে কেড়ে নেওয়া হয়েছে, শুধু প্রত্যাশার শ্রেণীভূক্ত করা হয়েছে। হকির মতো বারোয়ারি বিষয়। আজকাল কুমারীত্ব/কুমারত্বের কথা শুনলে ভ্রু কুঁচকে ওপরে ওঠে।

আর রনেটের কী হয়েছে? সব কিছু সত্ত্বেও অতীতে পড়ে আছে, যেখানে আলা-আঁধারের বিন্দু রয়েছে, যেখানে দাগ পড়ে গেছে ও বৃত্তাকার আলোর রূপরেখা দেখা যায়। অন্য মানুষের বিশেষণেও আটকে পড়ে আছে। এখন সবাই যখন আরও বেশি বাস্তবানুগভাবে নিজেদের পদাঙ্ক অনুসরণ করছে, তখন সে কী করছে? টেবিলে তার ওপাশে বসা ডনি খুব সম্ভবত এখন দশ বছর বয়সী সন্তানের বাবা। আর এ ব্যাপারে সে আদৌ কিছু জানে না।

রনেটের কি তাকে কিছু বলা উচিৎ? অতিমাত্রায় নাটকীয়তা তাকে প্রলুব্ধ করে, প্রকাশের ধারণা, একটা সংবেদন, একটা পরিপাটি সমাপ্তি।

কিন্তু এতে সমাপ্তি হবে না। এটা হবে শুধু অন্য কিছুর সূচনা। যা হোক, গল্পটা এমনিতেই মনে হচ্ছে মান্ধাতার আমলের। সেকেলে গল্প, লোক-কথা, মোজাইক প্রত্নবস্তু। এটা এমন এক গল্প যা এখন আর ঘটবে না।

***

পরিসমাপ্তি


৫ম পর্ব

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*