নদীও নারীর মতো

নিবন্ধ

নদীও নারীর মতো

-সেলিম মিয়া


রুকুর উপল্ধিজাত কথাটা শুনে দুখুর মনে আনন্দ পাতিলে জিইয়ে রাখা জিউল মাছের মতো কিলবিল করে ওঠে। তার আত্মাটা রুকুর আত্মার সাথে একাত্ম হয়ে ওঠে। অন্তরের গভীরতম জায়গা থেকে আপনা হতেই এক অনাবিল অনুভব জাগে। তারই প্রকাশ হিসেবে দুখু রুকুর কপালে আলতো করে চুমু খেয়ে বলে, ‘তোর নাখান গেরামের সগলে যদি বুঝতো!’

দুখু কথাটা শেষ করে রুকুর কপাল থেকে মুখটা সরিয়ে নেয়। নেয়ার পর ঘরের খড়ের ছাদের দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। সে দীর্ঘশ্বাস মিলে যায় পানির কলকলে ছোট ছোট ঢেউয়ের মধ্যে যা আসলে চারপাশ থেকে জড়ো হওয়া মানুষের ক্ষুব্ধ বিড়বিড়ানির ঢেউ। রুকু-দুখুর আলাপের মাঝামাঝি বৃষ্টি কিছুক্ষণের জন্য থেমে যায়। এ সুযোগে গ্রামের উচ্ছৃঙ্খল কিছু মানুষ তাদের ঘরের সামনে এসে জড়ো হয়।

রুকুও তা টের পায়। একটু সন্তর্পণে বন্ধ দরজায় কান পাতে। বেড়ার একটুখানি ফাঁক দিয়ে ঘটনাটা আঁচ করার চেষ্টা করে। দেখে গ্রামের বিশ-পঁচিশজন মতো মানুষ হাতে লাঠিসোটা, দা, কুড়াল ইত্যাদি প্রতিদিনকার ব্যবহার্য জিনিস নিয়ে তাদের ঘরের দিকে আসছে। রুকু দুখুকে উঠে এসে দেখতে বলে। অবস্থা দেখে দুজনার কারুরই বাকি থাকে না কী ঘটতে যাচ্ছে। জনস্রোত যতই কাছে আসছে, ততই নদী যেন আতঙ্কে কাঁপছে। সে কাঁপুনি ঢেউ আকারে একটু একটু করে বড় হয়ে ছড়িয়ে পড়ছে চারদিকে। কিছুটা কাছে এলে ঘর থেকে শোনা যাচ্ছে এ স্রোতের বিষোদগার।

কেউ একজন বলছে, ‘গাঙচিলের ইচ্ছেয় গেরামকে আজ অভিশাপ মুক্ত কইরবো। ওমার ঘরক দেবতার নামে বিসর্জন দেমো। জয়তু গাঙচিল!’ এ কথাকে সমর্থন জানিয়ে আরেক জনের কণ্ঠ ভেসে আসে, ‘হ, হ, এ্যাখনে সময়। এবারক্যা ছাড়ি’ দিলে হামার ঘরে দুক্কো কোনোদিন যাব্যার নয়’। আরেক কণ্ঠে রণিত হয়, ‘কত বড় সাহস! দেবতার নামে অপবাদ! বেঈমান! বেজন্মা!’ কেউ বলে, ‘বাইর হয়্যা দেখ খালি! তোমার ঘরে কপালত আজে মজা গুয়্যা ঠেকি’ হাতুর দিয়্যা ঠক ঠক করি’ বারি দ্যাম’। অন্য আরেক জন বলেই বসে, ‘দুরুক্কু, বাইর হ, দুইমারানি। মোর অনেক দিনের হাউস তোমার ঘরক মাইরব্যার। তোমার দুজনের রক্ত দিয়্যা মোর হাতদুট্যা পরিষ্কার করিম’। আরেক জন এর সরস উত্তর করে, ‘ওমার ঘরে রক্ত দিয়্যা হাত পরিষ্কার হবার নয়, ময়লা হোবে’। ‘হয় হোক!’ এই বলে আগের জন মুষ্টিবদ্ধ কুঁড়াল দিয়ে দরজায় জোরে একটা কোপ মারে।

রুকু-দুখুর সাথে সাথে নদীও ভয়ে কুঁকড়ে ওঠে। রুকু-দুখু বুঝতে পারে আর রক্ষা নেই। দুজনার মনে একই সুর বাজে— হায়রে মানুষ! তোমরা নিজের ভালও বুজিছ না। কী যে অন্ধ বিশ্বাস! বন্ধুক শত্রু বলে চেনায়। শত্রুক বানায় বন্ধু। হামার ঘরক মাইরলে যদি তোমার ঘরে দুক্কু যায়, তা্‌ইলে সেটাই হোক।

নদী আরও আতঙ্কিত হতে থাকে। যতই আতঙ্কিত হয়, ততই তার ঢেউগুলো বড় আকার ধারণ করে ঘর থেকে বাইরে এবং বাইরে থেকে ঘরে প্রবেশ করে। এবার ভয়কে ক্ষিপ্র ক্রোধে পরিণত করে নদী আরও স্ফীত হতে থাকে। রুকু-দুখু ঘরে থাকায় তাদের চৌকির উপর দাঁড়িয়ে পড়ে। বাইরের মারমুখী মানুষগুলো এবার কিছুটা ভয় পায়। তারা দেখে পানি কোমর পার করতে যাচ্ছে। তারা তখন মুখ ফিরায়। পানি আরও বেড়ে যায়। তারা বোঝে এখানে থাকা নিরাপদ না। উঁচু স্থানে আশ্রয় নিতে তাদেরকে ছত্রভঙ্গ হতে দেখা যায়। ভীতসন্ত্রস্ত মানুষগুলোর কেউ কেউ তখন গাছে চড়ে, কেউ নিজ ঘরের দিকে ফেরত যায়, কেউ-বা ঘরের ছাদে চড়ার প্রস্তুতি নেয়। এমন একজন নেংটি বেঁধে ছাদে উঠতে উঠতে রেগেমেগে বলে, ‘শালারা! তোমার ঘরে কপাল ভাল। মুই কী জিনিস আইজকে বুজি’ দিল্যাম হয়’। নদীকে রাগাতঙ্কে আরও ফুলতে দেখা যায় যতক্ষণ না সেখান থেকে সবাই চলে যায়। ঘরের ভেতরে রুকু-দুখু মনে করে তারা পড়েছে উভয় সঙ্কটে—বাইরে ক্ষুব্ধ জনতা, ভেতরে আকণ্ঠ পানি। কিন্তু এদের ভুল ভাঙে যখন এরা খেয়াল করে এর উপরে পানি আর উঠছে না। বন্যাকে অনেকটা স্থির ও শান্ত মনে হচ্ছে। বরং বাইরে শোরগোল কমে গেছে ও গ্রামবাসী ঘটনাস্থল ত্যাগ করেছে এবং সেই সাথে কিছুক্ষণের মধ্যে পানি একটু একটু করে আগের অবস্থায় পৌঁছে গেছে।

রুকু-দুখু বেশ অবাক হয়। তারা অন্তত এটুকু জানে যে কোনো কিছু্‌ই অলৌকিক নয়। গাঙচিলের দেবত্বেও তাদের বিশ্বাস নেই। সে তো নিজেকেই সামাল দিতে পারে না। অন্যের বড় বড় বিপদে কীভাবে সাহায্যের হাত বাড়াবে? বেশ কিছুক্ষণ চিন্তা করে যখন রুকু বলে যে আসলে ঘটনার সময়ে তুমুল বৃষ্টিপাত এবং উজান ঢলের জন্য এমন আকস্মিকভাবে নদীর পানি ফুলে ওঠে, তখন দুখুও এ কথার মধ্যে যুক্তি খুঁজে পায়। এর শক্ত প্রমাণস্বরূপ সে আরও খেয়াল করে যে সে সময়কার তুমুল বৃষ্টি এখন আর নেই। আকাশে মেঘদলের তাণ্ডবনৃত্যও নেই। যদিও ঘটনার সময় তারা শুনেছিল, তবে তা লোকদের শোরগোল ও এর ফলে আতঙ্কের দরুন তখন যেন মিইয়ে যায়। তবে যৌক্তিক-অযৌক্তিক বা লৌকিক-অলৌকিক—যে কারণেই হোক, এবারের মতো তারা রক্ষা পায়—এটাই বড় কথা। সবকিছুর উপরে জীবন বড়। আর এমনটা না হলে তো তাদের আজকে নির্ঘাত অপঘাতে প্রাণ হারাতে হতো নির্বোধ, অজ্ঞান অমানুষগুলোর হাতে। তা-ই নিয়ে তারা এতক্ষণে হয়তো উল্লাসে মেতে উঠতো।

নিজে প্রত্যক্ষ শিকার না হলেও নদীর মনে ঘটনাটি রেখাপাত করে। রুকু-দুখুর যৌক্তিক আলোচনা এবার তার কানে পৌঁছায় না। কারণ সে নিজে অন্যমনস্ক হয়ে ভাবে কোনো জীবনই সহজ নয়। ঝুট-ঝামেলা লেগেই থাকে। কখনও কখনও তা প্রাণঘাতীও হতে পারে। প্রাণ গ্রহণ, কষ্টে-সৃষ্টে তা ধারণ এবং প্রাণ নাশ—এ তিনের সমন্বয়ই বেশিরভাগ জীবন। যতই সে বড় হচ্ছে, নতুন নতুন জীবন ও পরিপার্শ্ব দেখছে, ততই সে জীবনের নানা অন্ধকার দিকের উন্মোচন করছে। যদিও রুকু-দুখুর মতো প্রদীপের দেখাও পাচ্ছে, তবে সে আলো নিতান্তই অপ্রতুল। মনে মনে মেঘকে অনেক ধন্যবাদ দেয়। কারণ নদী তার স্বাভাবিক গতিপথ থেকে সরে গিয়ে অন্যের বাড়ি বাড়ি গিয়ে অভিসারে যাচ্ছে মনে করে মেঘের সন্দেহ ও ঈর্ষা জাগে। তার ফলে ঈর্ষাবশত সে তাণ্ডবলীলা করে এবং মনের অস্থিরতা বৃষ্টি আকারে ঝরায়। তা না হলে সেই মুহূর্তে নদী রুকু-দুখুর চত্বরের দৃশ্যটি সহ্য করতে পারতো কিনা সন্দেহ আছে।


৪র্থ পর্ব                                                                                                                       চলবে

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*