নদীও নারীর মতো

নিবন্ধ

নদীও নারীর মতো

-সেলিম মিয়া


নদী ঘুরে ঘুরে দেখে জায়গাটা। কখনো মজার, কখনো অদ্ভূত, আবার কখনো-বা অনর্থক বোকামিপূর্ণ লাগে এখানকার কর্মকাণ্ড। এতদিন সে এসব জনপদের অনেক নিচ দিয়ে বয়ে গেছে বলে এত কাছ থেকে নিজের মর মর এ অংশটি দেখা হয়নি। ফলে এতদিন যে ধারণা সে লাভ করেছে তার অনেকটা বিপরীত চিত্র মেঘের বদৌলতে আজ দেখার সুযোগ মেলে। তবে জায়গাটির ভেতরে যাওয়ার আগে দূরে থাকতেই দেখে একটা দলের চিত্র। দলটি গোল পাকিয়ে পাড়ে বসে কিসের যেন গোপন সভা করছে মনে হলো। গ্রামের মাতব্বর প্রকৃতির দুজন, তাদের সেবাতৎপর দুজন অনুগতের মতো এবং ভিন্ন গড়ন ও বর্ণের দুজনকে বসে আলাপ করতে দেখে সে। তবে এত দূর থেকে  ঠাহর করতে পারে না তারা ঠিক কী করছে। সে যখন এ দলটির কাছাকাছি আসে তখন তারা মিলিয়ে যায়।

অনাবিস্কৃত পথে চলার একটা দুঃসাহসিক আনন্দ থাকে। থাকে ভয় ও কৌতূহল। এসব সাথে নিয়েই নদী কলকল নৃত্যে বয়ে চলে ভুট্টা, ধান, কাউন ও পাটক্ষেতের মধ্য দিয়ে। সে জানে এসব ক্ষেতের মধ্য দিয়ে চললে মানুষজনের সর্বনাশ হবে, প্রাণহানি ঘটবে অনেক কীটপতঙ্গের। সাপ জাতীয় সরীসৃপ প্রাণ রক্ষার্থে মানুষের ঘরে ঘরে আশ্রয় নেবে। সঙ্গে সঙ্গে মানুষ ও কীটের মধ্যে দ্বন্দ লেগে যাবে। এতে হয় মানুষ নয়তো সে কীট মারা যাবে। এছাড়া ফসলহানির ফলে হয়তো একটা ঋতুতে মানুষ ও গবাদি পশু উপবাসেই থেকে যাবে। ঘরে ঘরে চলবে হাভাত। হবে না কোনো উৎসবের বাড়তি আনন্দ। তবু নদীর কিছু করার নেই। এখানে যাওয়ার একমাত্র রাস্তা একটাই। এরপর সে চলে যায় প্রতিটি বাড়ির আনাচে-কানাচে, এমনকি কোনো কোনো বাড়ির অন্দর মহলেও।

এখানকার পূর্বপুরুষেরা হাড্ডিসার জায়গাটার নাম দিয়েছিলো রায়দাশনগর। নামের শেষে ‘নগর’ শব্দটি থাকলেও নগর চরিত্রের কোনো বিন্দু-বিসর্গ নদী এর মধ্যে খুঁজে পায় না। তবে তার দিক থেকে অর্থ করলে ঠিক আছে। নগর তো গ্রামেরই হাড্ডি। প্রকৃতির নিজস্ব অকৃত্তিম রূপ-রস সেখানে মেলে না। তার নিজের জলমজ্জাও সেখানে পৌঁছায় না। কিন্তু জনপদের দৃষ্টিকোণ থেকে সেটা নিতান্তই চরগ্রাম। কিংবা চারিদিকে জল থাকায় বড়জোর ছোটখাট একখানা দ্বীপ বলা যেতে পারে। নদী ঘুরে ঘুরে দেখতে পায় এ দ্বীপের লোকজন বিপদে-আপদে, সঙ্কট-বিরহ-বেদনায় থাকলে তাদের দেবতার পানে চেয়ে প্রার্থনা করে। এ দেবতাকে তারা ‘গাঙচিল’ বলে।

তাদের বিশ্বাস জমায়েতের প্রার্থনায় দেবতা সর্বসাধারণের কথা শোনে, আর একক প্রার্থনায় ব্যক্তির কথা শোনে।  শুধু রুকু ও দুখু নামে এক দম্পতি এ সবে বিশ্বাস করে না। সে জন্য অবশ্য তারা সমাজচ্যূত প্রায়। তবে দেবতার অস্তিত্ত্ব তারা অনুভব করে মানবিক অনুভবের মধ্য দিয়ে। এ দম্পতিকে দেখলে সারা গ্রামের মানুষ কথা বলার বিষয় খুঁজে পায়। অযথা টিপ্পনী কেটে সুখ পায় এবং শ্রোতার মাঝে তা সঞ্চারিত করেও মজা পায়। আবার কখনো গল্পের ছলে দূরের কোনো আড্ডায় বদ নজির হিসেবে উপস্থাপন করে। কারও আচরণ বা কথা তাদের মন মতো না হলে এ দম্পতির নাম উচ্চারণ করে তাদেরকে গালি দেয়। এদের অভিধানে রাগ-ক্ষোভ প্রশমনের বহুল উচ্চারিত আরেক গালি হচ্ছে ‘দুরুক্কু’।

টানা দুদিনের বৃষ্টির মধ্যে বাইরে বের হওয়া যাচ্ছে না বলে গ্রামের প্রায় সবাই ঘরে বন্দী হয়ে আছে। বসে বসে মুড়ি, চা, চানাচুর, চিড়া ইত্যাদি শুকনো খাবার খাচ্ছে। আর তুমুল মৌসুমী বৃষ্টিপাতের দরুণ যে অস্থায়ী বন্যার মতো সৃষ্টি হয়েছে রুকু-দুখুর উপর তার কারণ আরোপ করে তাদেরকে অভিশাপ ও গালিগালাজের বর্ষণে ভিজিয়ে জবজবে করছে। নদী একেক ঘরে একেক কটূক্তি শুনতে পায়। কোনো ঘরে শোনে ‘ঐ দুরুক্কু শালী! চুলা জ্বালা’। কোনো ঘরে শোনে, ‘তুই একটা দুরুক্কু। যা-ই কম মানে করিস উল্টে’। ‘রুকু-দুখুক গ্রাম ছাড়া না কল্লে এ বিষ্টি থামবের নয়’। কিংবা ‘গাঙচিলের গজব পচ্ছে দুরুক্কুর জইন্যে’। এ রকম নানা কথা।

এসব কথার সাথে ফলের কোনো কার্যকারণ সম্পর্ক খুঁজে পায় না নদী। তার কাছে মনে হয় আজব, ভিত্তিহীন কারণে গ্রামের প্রায় সবাই এ দুজনকে দোষারোপ করছে। নিজেদের ও গ্রামের ভাগ্যোন্নয়নের পরিবর্তে তারা কুসংস্কার নিয়ে মেতে আছে। মেঘের সাথে তিক্তমধুর বন্ধুত্ব থাকায় সে তো জানে এর প্রকৃত কারণ। কিন্তু এ ভেবে পায় না যারা নিজেদের সৃষ্টির সেরা জীব হিসেবে বলে বেড়ায়, তারা কীভাবে এমন অযৌক্তিক বিশ্বাস লালন করে এবং তার ভিত্তিতে এক জোড়া জীবকেই সব বিপদের কারণ হিসেবে বিবেচনা করে। মানুষ কোন বিবেচনাবোধে নিজেকে এমন শ্রেষ্ঠ মনে করে? অন্য প্রজাতিদের মধ্যে তো এমন নৈরাজ্য ও অসঙ্গতি দেখা যায় না। তবে এ কি গাঁয়ে মানে না আপনি মোড়ল? নদীর কাছে আরো অবাক লাগে যখন সে রুকু-দুখুর ঘরের কিনার ধরে যায়, ভেতরে প্রবেশ করে এবং তাদের সংক্ষিপ্ত কথোপকথন শোনে:


৩য় পর্ব                                                                                                                        ৫ম পর্ব

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*