নদীও নারীর মতো

নিবন্ধ

নদীও নারীর মতো

-সেলিম মিয়া


তবু বয়ে চলে নদী, কিন্তু সহ্য হয় না। না চলে তার উপায় নেই, তাই চলে। থেমে যাওয়া মানে তার মৃত্যু। সে মরতে চায় না। কিংবা আত্মহত্যা করার দুঃসাহস নেই তার। না পাওয়া সত্ত্বেও জীবনকে সুন্দর মনে হয়। কারণ এর ওপারের অন্ধকারকে সে চেনে না। যে অন্ধকারকে অনেকেই গৌরবান্বিত করে, চেনা আলোর চেয়ে বেশি আলোকিত ও মূল্যবান মনে করে। যে অন্ধকারের ভয় দেখিয়ে অনেকে নিজের স্বার্থসিদ্ধি করে, আবার শাসনও করে। সেটা করলেও ঐ জগতের বাসিন্দা কেউ স্বেচ্ছায় হতে চায় না।

চেনা জগতের বাইরে কে-ই বা পা বাড়ায়? সবাই তো ভাস্কো দা গামা কিংবা কলম্বাস নয় যে অসম্ভব দুঃসাহসের ক্ষমতা রাখে। এর বাইরে যারা পা বাড়ায় তারা মোটামুটি জেনেই বাড়ায়।

নদী চলছে শুধু আশার ডানায় ভর করে। একদিন দেখা হবে, বসে বসে গল্প হবে, যুগল কণ্ঠে গান হবে, নৃত্য হবে সাগরের সাথে। হয়তো সাগরবেলায় বিকেল থেকে সন্ধ্যায়  আকাশ ও মেঘের মুখ্য অভিনয়ে রোমান্টিক কোনো সিনেমা দেখবে। আর তখন নিজেদেরকে সেই জায়গায় কল্পনা করে নিজেরাই নায়ক-নায়িকা বনে যাবে। সে সময় হয়তো পূর্ণিমার চাঁদখানি নিজের জোছনার মতো মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকবে। দিগন্ত জুড়ে পাখিগুলি তাদের মিলনের গান গেয়ে অবশেষে নীড়ে ফিরবে। জেলেরা এই মিলনের সুযোগ নিয়ে আরো বেশি বেশি মাছ ধরবে। আর সে জন্য মনের সুখে গান ধরবে। যে গান সেই মিলনের আবহসঙ্গীত হিসেবে বাজবে। নদী তাই আজো চলে। আর স্বপ্ন দেখে। স্বপ্ন এবং আশা ছাড়া বাঁচার আর কোনো অবলম্বন নেই তার।

চলার পথে কত কিছুরই না প্রত্যক্ষ সাক্ষী সে। অভিজ্ঞতাও বা কম কিসে? সে এখন জানে দেহজাত কিংবা গুণজাত সৌন্দর্যের একটা দিক হলো উভয়েই মাকড়সার মতো জাল বিছিয়ে এবং সেই জালের কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থান করে শিকার ধরতে চায়। ফলে বেশিরভাগ সময় নিম্নমানের শিকারের শিকার হতে হয় তাকে। ফুলদলও ঠিক তাই করে। তাই যে কোনো ভ্রমরই এসে হানা দেয় ফুলের পাঁপড়িতে।

শিকার ধরার এই নিস্ক্রিয় কৌশল বাঘ-সিংহ-কুমীরের শিকার ধরার সক্রিয় কৌশলের একেবারে উল্টো। কারণ সক্রিয় কৌশলে বাঘ-সিংহ-কুমীর অনেক শিকারের মধ্য থেকে নিজের পছন্দমত শিকার বেছে নেয়।

নদী এও জানে যার গতিপথ নির্দিষ্ট কিংবা বাঁধা তার সক্রিয় কৌশল থাকে না।  কৌশলী হতে হলে তাকে মায়াবীই হতে হয়। তার গতিপথ অনেকটা বাঁধা। ঠিক যেন রাতে ফোটা ফুল। অন্ধকারে ফোটে বলে নিজেকে শাদা ও সুগন্ধিময় করে ফোটে যাতে এক মায়ার সৃষ্টি হয়। যে মায়ায় তার কাঙ্খিত পতঙ্গ আপনা থেকেই ধরা দেয়। তার মানে লক্ষ্যে পৌঁছাতে হলে তাকেও মায়াবী কিংবা ছলনাময়ীই হতে হবে।

সে মায়াবী হওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু তার মায়া যার উদ্দেশ্যে সে তো কিছুতেই দেখতে পাবে না তা। দেখবে মেঘ, বৃক্ষ, পাখ-পাখালি, চাঁদ, সূর্য, তারা, হিমেল বা দমকা হাওয়া, নৌকা, জাহাজ, বন্দর, এবং বড় জোর দু’পারের জনপদ। মায়ার জালে এদের আটকিয়ে কী লাভ? তবু মায়াবী হওয়া ছাড়া তার উপায় নেই। এদের সবাইকে ডিঙিয়ে যদি মায়াবতীর খবর পৌঁছায় কখনো সাগরের কাছে—এই তার আশা। আকাশে একের পর এক ছাইরঙা মেঘ যখন জড়ো হয়, তখন সে জলের আয়নায় নিজের মুখখানি দেখে। বৃষ্টি হওয়ার প্রাক্কালে কালো মেঘ থেকে চোখে কাজল মেখে নেয়। চাহনি করে তোলে ঘাস চিবানো অবস্থায় একটুখানি আওয়াজ পাওয়া মায়ামৃগের মতো সজাগ। মেঘের ফাঁকে ফাঁকে উঁকি দেওয়া সূর্যটাকে কপালে টিপ হিসেবে পরে নেয়। আর এর অপরাহ্নের আলোয় নদীর মুখখানি যখন চিকচিক করে ওঠে, তখন এই সুযোগে মেঘ নদীর সাথে নিজের পরপর তিনটি নিজস্বী তুলে নেয়। নদী তাতে কিছু বলে না। এটা সে নিজের রূপের প্রশংসাই ভেবে নেয়। ছবি তোলার পর মেঘ কী ভেবে যেন তুমুল বর্ষণে নদীকে ছুঁতে আসে। নদী স্ফীত হতে থাকে। এগিয়ে যায়। এ বর্ষণে মেঘের যা-ই লাভ হোক, নদীরও একটা লাভ হয়েছে। জল-মজ্জার অভাবে তার যে হাড্ডিসার দেহের অংশটুকু কাছ থেকে ঘেঁটে ঘেঁটে দেখা হয়নি এতদিন তা দেখার সুযোগ হলো।


২য় পর্ব                                                                                                                              ৪র্থ পর্ব

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*