নদীও নারীর মতো

নিবন্ধ

নদীও নারীর মতো

-সেলিম মিয়া


অবশ্য নদী যে অন্যের শুধু সর্বনাশেই করে গেছে এমন নয়। উপকারের তালিকাটাও তো দীর্ঘ।  সে নিজেকে বাঁচিয়ে রেখেছে বলেই তো নানা ধরণের মাছ তার পেটের মধ্যে বসবাস করে। সেই পেটের জীবানু ও ময়লা খেয়ে তারা নিজেদের গতর পরিপুষ্ট করে। আর জেলেরা সেই মাছকে ধরে হয়ে যায় মৎসজীবী। সেই মাছ যে এত সুস্বাদু হয় তা আর কোথায় মিলবে? পুকুরের মাছ হোক আর হাওড়-বাওড়-বিলের মাছ হোক, কিংবা সমুদ্রের মাছ হোক এ অপূর্ব স্বাদ কেউ দিতে পারবে না। আর এই মাছ খেয়েই তো মানুষজনের এত শক্তি! অনেকেরই প্রিয় প্রধান খাদ্য হওয়ায় কেউ কেউ এমনও বলে ‘মাছে-ভাতে বাঙালী’। এছাড়া নদীর বুকে বিকেল বেলা পালতোলা নৌকা চালিয়ে মানুষজন যে প্রমোদভ্রমণ কিংবা বাণিজ্য করে, রাতের বেলা শীতল হাওয়ায় সেই নৌকায় গা এলিয়ে দিয়ে আকাশে তারাদের সূচকর্ম ও চাঁদের মনভোলানো হাসি দেখার মতো নয়নাভিরাম দৃশ্য উপভোগ করে তা তারা আর কোথায় পাবে? সূর্যের তাপে বাতাস যখন তেতে ওঠে, তখন সে বাতাসও তো নদীর বুক ছুঁয়ে শীতল হয়। দেহের যে অংশ জল-মজ্জার অভাবে হাড্ডিসার হয়েছে, সেখানেও তো কত মানুষ-বৃক্ষ-প্রাণী আশ্রয় নিয়ে আছে। চখাচখি, বালিহাঁসের মতো শীতের কত শত পরিযায়ী পাখি একটু উষ্ণতার জন্য উড়ে উড়ে ঘোরে, শ্যাওলা ও মাছ খেয়ে জীবন ধারণ করে। এছাড়া বর্ষার প্রয়োজনাতিরিক্ত দানের জন্য তার পেটের মধ্য থেকে যে জাউয়ের মতো নরম বমন হয় তাতে তো ফসলি জমিনে দ্বিগুণ উৎপাদন হয়। যার ফলে মানুষ উৎসবে বাড়তি আনন্দ করার সুযোগ পায়। এ তো মৌমাছির মধু বমনের মতো। নদী ছোটে যার টানে তার দেখা না মিললেও তার চলাতে অনেকেই লাভবান হয়।

বিশ্বপ্রকৃতির এ এক আশ্চর্যজনক শৃঙ্খলা। সত্যি করে কেউ জানে না সে কেন চলে। হয়তো এক মায়ার অনুভবে। কিন্তু তার এ চলা বিশ্বপ্রকৃতির অন্যান্য জীবের উপকারে আসে। এর মধ্য দিয়েই বিশ্ববৈচিত্র্য বিদ্যমান। তাই এ নিয়মকে জিইয়ে রাখতেই বুঝি বিশ্বপ্রকৃতি এ ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। এই যে একজনের বিলোপ এবং আরেকজনের জন্ম বা টিকে থাকা, এক সময় তারও বিলোপ এবং আরেকজনের টিকে থাকা—এই ধারাবাহিকতার শেষ কোথায় কে জানে? এই চির-যা্ত্রায় পাত্র-পাত্রী বা বাহন বদলায়, রেখে যায় শুধু চিহ্ন। এক চিহ্ন হারিয়ে যায়, রেখে যায় আরেক চিহ্ন। এভাবে চিহ্নের পর চিহ্নের মাধ্যমে চলছে অবিরাম যা্ত্রা। সে চিহ্ন ধারণ করে, বহন করে পূর্বপুরুষের বৈশিষ্ট্য যদিও সময়ের সাথে সাথে কিছুটা পরিবর্তিত হয়।

তবু নদী এখনো শুধুই মিঠা জলের সন্তরণকারিণী। যে চিহ্নের অধিকারিনী সে সেই চিহ্ন তাকে সাগরের দিকে অনবরত টানে। তার নিজের ইচ্ছাও ঐ চিহ্নের দ্বারা চালিত। কিন্তু সাগরের নোনা জলে এখনো অবগাহনের সুযোগ হয় না তার। অন্তত তার এই টগবগে উদ্ভিন্ন যৌবনে। হয়তো সাগরের কাছে পৌঁছাবে সে। তবে তখন সে প্রৌঢ়া হবে নয়তো বৃদ্ধা হবে। ততদিনে তার বুক নিম্নগামী হয়ে ঝুলে যাবে। চামড়া কুঁচকে হেমন্তের ঝরা পাতার মত শুকিয়ে যাবে। ঠোঁটে থাকবে না কামনার সজীবতা ও প্রেমের স্নিগ্ধতা।

এখন মেঘ দু’তিনবার ফিরিয়ে দিলেও নদীর যৌবনের লোভে শেষে ঠিকই জল দান করে। কিন্তু প্রৌঢ়ত্বে কি সেই মেঘ আগের মতো জল ঢালবে? খুব সম্ভবত না। রীতির বাইরে যাবার অপ্রাকৃতিক ক্ষমতা কার-বা আছে! তাছাড়া তখন নোনা জলের স্পর্শের প্রখরতা হয়তো সহ্য হবে না শরীরে। অথচ এই স্পর্শের জন্যই তার পথচলা। এ যেন পুকুরে জল আনতে গিয়ে বৃষ্টির চোটে ঘরে ফেরা।

তার বদলে সে দেখে সেই উনিশ কিংবা বিশ বছর বয়সী আকাশের দূরন্ত সূর্যটাকে যে কিনা যোজন যোজন দূরে থেকে আশার আলোর ঝলকানি দেখায়। কিন্তু অধরাই থেকে যায়। লোভ দেখায়, কিন্তু প্রলুব্ধ হয় না। ঈশারায় ডাকে, কিন্তু পালিয়ে বেড়ায়। হাতছানি দেয়, অথচ মুখ ফিরিয়ে রাখে। এ কেমন খেলা?


১ম পর্ব                                                                                                                                  ৩য় পর্ব

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*