ডেথ বাই ল্যান্ডস্কেপ – অনুবাদ

গল্প

ডেথ-বাই-ল্যান্ডস্কেপ

ডেথ বাই ল্যান্ডস্কেপ

মূল: মার্গারেট এটউড

অনুবাদ: সেলিম মিয়া


ক্যাপিরও একই ব্যাপার। আপনাকে তার সাথে অভ্যস্ত হতে হবে। সম্ভবত তার বয়স ছিল চল্লিশ কিংবা পঁয়ত্রিশ অথবা পঁঞ্চাশ। তার ছিল হালকা বাদামি রঙা চুল। চুলগুলো এমন দেখাত যেন গামলা ছাঁট দেওয়া হয়েছে। ক্যাম্পের চারদিকে যখন হেঁটে যেত, তখন তার মাথাটা বের হয়ে থাকত। যেন মুরগির মাথার মতো ওপর-নিচ করছে। নোটবুকগুলো হাতে নিয়ে সে এটা-সেটা দেখত। গির্জায় তাদের মন্ত্রীর মতো ছিল সে। তারা দুজনেই খুব হাসাহাসি করত। আর দুশ্চিন্তা করত। কারণ তারা চাইত সব কিছু ভালোভাবে হয়ে যাক। তাদের দুজনেরই ছিল অতিরিক্ত ধোয়া ত্বক ও সরু ঘাড়। কিন্তু এসব কিছু অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল যখন ক্যাপি সমস্বরে গান গাইছিল কিংবা অন্যভাবে নেতৃত্ব দিচ্ছিল। তখন নিজের ব্যাপারে নিশ্চিত হয়ে সে খুব খুশি হয়েছিল। তার শাদামাটা মুখখানি প্রায় জ্বলজ্বল করছিল। সে আনন্দ ঘটাতে চেয়েছিল। এ সময়গুলোতে তাকে সবাই ভালোবাসত। অন্য সময়গুলোতে শুধু বিশ্বাস করত।

ক্যাম্প ম্যানিটোর এমন অনেক জিনিস ছিল যা লোয়াসের প্রথমে ভালো লাগেনি। ডাইনিং হলের গোলমেলে বিশৃঙ্খলা ও চামচের টুংটাং সে ঘৃণা করত। হৈ-চৈ করে সমস্বরে গান গাওয়াকেও ঘৃণা করত। এসব গানে আশা করা হত আপনি জোরে জোরে চিৎকার করবেন যাতে করে দেখানো যায় যে, আপনি উপভোগ করছেন। তার বাড়িটা এমন ছিল না যেখানে চিৎকার-চেঁচামেচিকে উৎসাহিত করা হত। সে যে মজা করছিল সেটা দাবি করে তার পিতামাতাকে দায়িত্ববানের মতো চিঠি লেখার প্রয়োজনীয়তাকেও সে ঘৃণা করত। কোনও অভিযোগ জানাতে পারত না, কারণ ক্যাম্পে এতে খুব বেশি টাকা লাগত।

অনুজ্জ্বল আলোতেও ঘরভর্তি অন্য মেয়েদের সামনে নগ্ন হওয়াটাকেও সে খুব বেশি পছন্দ করত না। যদিও কেউ কোনও মনোযোগ দিত না। অথবা অন্য সাতটা মেয়ের সাথে ক্যাবিনে ঘুমাত। এসব মেয়েদের কেউ কেউ আবার নাক ডাকত। কারণ তাদের অ্যাডিনয়েড কিংবা সর্দি ছিল। কেউ কেউ দুঃস্বপ্ন দেখত কিংবা কান্নাকাটি করে বিছানা ভিজিয়ে দিত। নিচের বাঙ্ক বিছানায় সে জবুথবু বোধ করত। আর ওপরের বিছানা থেকে কেউ পড়ে যাচ্ছে এমন আশঙ্কা করত। উচ্চতাকে ভয় করত সে। বাড়ির কথা মনে পড়ত। আর সন্দেহ করত যে, বাবা-মা তার উপস্থিতির তুলনায় তার অনুপস্থিতিতে ভালো সময় কাটাচ্ছে। যদিও তার মা তাকে প্রতি সপ্তাহে লিখে জানাত যে, তার কথা তাদের কতটা মনে পড়ে। এসব হয়েছিল তার নয় বছর বয়সে। চৌদ্দ বছর বয়স নাগাদ এটা তার ভালো লেগেছিল। এ সময়ের মধ্যে অনেক কিছু দেখতে ও বুঝতে শিখেছিল সে।

ক্যাম্পে তার সবচেয়ে ভালো বন্ধু ছিল লুসি। শীতকালে যখন স্কুল থাকত এবং বিকেলের অন্ধকারে পশমি কাপড়ে চুলকানি হত, তখন লোয়াসের অন্য বন্ধু-বান্ধবীও ছিল। তবে লুসি ছিল তার গ্রীষ্মকালীন বন্ধু।

লোয়াসের বয়স যখন দশ বছর এবং ব্লু জে ছিল, তখন লুসি দ্বিতীয় বর্ষে এসেছিল। (শিকাডি, ব্লু জে, র্যাভেন এবং কিংফিশার—এ নামগুলো ক্যাম্প ম্যানিটো ভিন্ন ভিন্ন গ্রুপকে দিয়েছিল। এক ধরণের টোটেমিক বংশ প্রথা। লোয়াস ভাবে, সেই দিনগুলোতে মেয়েদের জন্য পাখি, ছেলেদের জন্য প্রাণী যেমন—নেকড়ে বাঘ ইত্যাদি ছিল। তবে কখনও শকুন ছিল না। কখনও স্কান্ক কিংবা ইঁদুর ছিল না।)

লুসির টিনের ট্রাঙ্ক খুলে ভাঁজ করা কাপড়-চোপড় কাঠের তাকে রাখতে লোয়াস সাহায্য করেছিল। তার বিছানা তৈরিতেও সাহায্য করেছিল। লোয়াসের ওপরের বাঙ্ক বিছানায় তাকে রেখেছিল। সেখানে তার দিকে নজর রাখতে পারত। এরই মধ্যে লোয়াস জেনে গিয়েছিল যে, লুসি নানা নিয়ম-কানুনের ব্যতিক্রম। এরই মধ্যে মালিক মালিক অনুভব করেছিল।

লুসি এসেছিল যুক্তরাষ্ট্র থেকে। এখান থেকেই হাসি-কৌতুক ও ছায়াছবির বইগুলো আসত। লোয়াস যে সব নগরীর নাম জানত, যেমন— নিউ ইয়র্ক কিংবা হলিউড বা বাফেলো, লুসি সেসব নগরী থেকে আসেনি। এসেছিল শিকাগো থেকে। লুসির বাড়ি ছিল জলাশয়ের ধারে এবং গেট ছিল। আরও ছিল চারদিকে বিস্তীর্ণ ভূমি। তাদের একজন কাজের মেয়ে ছিল সব সময়। আর লোয়াসের পরিবারে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কাজের জন্য একজন মহিলা ছিল, যে সপ্তাহে দু’বার আসত।

কেবল যে কারণে লুসিকে এই ক্যাম্পে পাঠানো হচ্ছিল (ক্যাবিনের চারপাশে তুচ্ছ অবজ্ঞার দৃষ্টি নিক্ষেপ করে, তাচ্ছিল্য করে লোয়াসের মনে আঘাত দিয়েছিল এবং একই সাথে সন্ত্রস্ত করে তুলেছিল।) তা ছিল এই যে, তার মাও এখানে একজন ক্যাম্পার ছিলেন। তিনি একবার কানাডিয়ান হয়েছিলেন। কিন্তু লুসির বাবাকে বিয়ে করেছিলেন। বাবার এক চোখে জলদস্যুর মতো একটা পট্টি ছিল। লুসি তার ওয়ালেটে রাখা বাবার ছবিটি লোয়াসকে দেখিয়েছিল। যুদ্ধে তার বাবাকে পট্টিটা পরতে হয়েছিল। লুসি বলেছিল, ‘ক্ষেপণাস্ত্র’। লোয়াস ক্ষেপণাস্ত্র সম্পর্কে অনিশ্চিত ছিল। তবে এতটাই মুগ্ধ হয়েছিল যে সে তখন শুধু মৃদু স্বরে কথা বলতে পারত। তার নিজের দু’চোখা, অক্ষত বাবা তুলনামূলকভাবে বশ্য ছিলেন। অবশেষে সাহস করে বলেছিল, ‘আমার বাবা তো গল্ফ খেলেন।‘

লুসি বলেছিল, ‘সবাই গল্ফ খেলে। আমার মাও গল্ফ খেলেন।‘

লোয়াসের মা খেলতেন না। লোয়াস লুসিকে বহিঃস্থ ঘর, সাঁতার কাটার ডক এবং মন্টি ম্যানিটোর ভীতিকর মাথাসহ ডাইনিং হল দেখতে নিয়ে গিয়েছিল। সে আগে-ভাগেই জানত যে, তারা এতে সফল হবে না।

শুরুটা খারাপ ছিল। কিন্তু লুসি ছিল ভালো প্রকৃতির। সে ক্যাম্প ম্যানিটোকে একইভাবে ঘাড় নেড়ে গ্রহণ করেছিল যেভাবে অন্য সব কিছুকে সে গ্রহণ করত। সে যা করতে যাচ্ছে তা লোয়াসকে ভুলতে না দিয়ে এর সর্বোত্তম ব্যবহার করত।

অবশ্য এমন বিষয়ও ছিল যা লোয়াস জানত, কিন্তু লুসি জানত না। মশার কামড়ের জায়গাগুলো চুলকাতে চুলকাতে চামড়া তুলে ফেলত লুসি এবং তাকে ওজোনল মাখিয়ে দেওয়ার জন্য বিশেষ কক্ষে নিয়ে যেতে হত। নৌ-ভ্রমণের সময় সে তার টি-শার্টটি খুলে ফেলত। আর কাউন্সেলর যদিও কিছুক্ষণ পর দেখে ফেলে আবার সেটা তাকে পরিয়ে নিতেন, তবুও সে জমকালোভাবে দগ্ধ হয়ে উজ্জ্বল লাল হয়ে যেত। গোসলের কাপড়ের ফিতাগুলোর ক্রস চিহ্নটি আতঙ্কজনক শাদার স্বাতন্ত্র্যে দেখা যেত। তার ঘাড় থেকে ফিসফিসানির মতো সরু পোড়া চামড়াগুলো লোয়াসকে উঠাতে দিত। ক্যাম্পফায়ারের চারপাশে যখন তারা ‘আলুয়েত’ গাইত, সে তখন ফরাসি কোনও শব্দ জানত না। পার্থক্যটা ছিল, যে জিনিস লুসি জানত না তাকে সে পাত্তা দিত না। অন্যদিকে লোয়াস দিত।

পরবর্তী গ্রীষ্মে ও পরের শীতগুলোতে লুসি ও লোয়াস পরস্পরের কাছে চিঠি লিখত। তারা দুজনেই নিছক শিশু ছিল। এ সময়ে এটাকে ভাবা হত অসুবিধা হিসেবে। তাই তাদের চিঠিপত্রে তারা বোন সেজেছিল অথবা সেজেছিল জমজ। এ জন্য লোয়াসকে একটু বেশি কিছু করতে হয়েছিল। কারণ লুসি ছিল খুব ব্লন্ড। পুতুলের চোখের মতো আয়ত নীল চোখ ও ইষৎ স্বচ্ছ ত্বক ছিল তার। আর লোয়াসের অসাধারণ কিছু ছিল না। একটু লম্বা, একটু তন্বী, একটু বাদামি ছিল সে। আর মুখে ছিল দাগ। তারা চিঠিতে স্বাক্ষর করত ডবল এল দিয়ে। তোয়ালের মনোগ্রামের মতো একসঙ্গে এল দুটো জুড়ে দিতে। (লোয়াস ভাবে, লোয়াস ও লুসি। আমাদের নামগুলো কীভাবে আমাদের সাথে ডেট করছে। লোয়াস লেন, সুপারম্যান’স গার্লফ্রেন্ড, উদ্যোগী নারী রিপোর্টার। ‘আমি লুসিকে ভালোবাসি।‘ আমরা এখন অচল। এখন তো লিটল জেনিফারস, লিটল এমিলিস, লিটল আলেক্সান্ড্রাস ও ক্যারোলাইনস এবং টিফানিস।)

সামনাসামনি তারা যতটা না উচ্ছ্বাস প্রকাশ করত চিঠিতে করত তার চেয়ে বেশি। চিঠির পৃষ্ঠাগুলোতে তারা ‘এক্স’ দিয়ে সীমানা চিহ্নিত করত। কিন্তু গ্রীষ্মে যখন তাদের আবার দেখা হত, তখন সব সময়ের জন্য সেটা হত একটা আঘাত। তারা এতটাই বদলে যেত। অথবা লুসি যেত। বিষয়টা যেন কাউকে আঘাতের মধ্যে বড় হতে দেখার মতো। প্রথম দিকে কোনও কিছু বলার মতো চিন্তা করাটা কঠিন হত।

কিন্তু লুসির সব সময় একটা-দুটো চমক ছিল—কিছু একটা দেখানোর, কিছু বিস্ময় প্রকাশ করার। প্রথম বছর সে টুটু স্কার্ট পরে ছবি তুলেছিল। ব্যালে নর্তকীর চুল বাঁধার ধরণে মাথার ওপর তার চুল বেঁধেছিল। সাঁতার কাটার ডকটির চারপাশে ব্যালে নর্তকীর মতো করে হেঁটেছিল লোয়াসকে দেখাতে যে, কীভাবে এই হাঁটা হাঁটতে হয়। এটা করতে গিয়ে প্রায় পড়ে গিয়েছিল সে। পরের বছর সেটা ত্যাগ করে ঘোড়ায় চড়ছিল। (ক্যাম্প ম্যানিটোতে ঘোড়া ছিল না।) এর পরের বছর তার বাবা-মায়ের তালাক হয়ে গিয়েছিল। আর তার নতুন একজন সৎ বাবা হয়েছিল, যার দুটো চোখই ছিল এবং নতুন একটা বাড়ি ছিল। কাজের মেয়ে যদিও একই ছিল। পরের বছর যখন তারা ব্লু জে থেকে স্নাতক পাশ করে র্যাভেনে প্রবেশ করেছিল, তখন ক্যাম্পের প্রথম সপ্তাহে তার মাসিক হয়েছিল। কাউন্সেলর যিনি অবৈধভাবে ধূমপান করতেন, তার কাছ থেকে তারা দুজনেই কিছু দেয়াশলাইয়ের কাঠি গোপনে সরিয়ে গোধূলি বেলায় টর্চলাইট জ্বালিয়ে দূরবর্তী বহিঃস্থ ঘরের পিছনে ছোট্ট একটা আগুন তৈরি করেছিল। তখন তারা সব ধরণের আগুন জ্বালাতে পারত। ক্যাম্পক্রাফটে তারা শিখেছিল কীভাবে বানাতে হয়। আগুন জ্বালিয়ে লুসির ব্যবহৃত একটা স্যানিটারি ন্যাপকিন তারা পুড়ে ফেলেছিল। লোয়াস নিশ্চিত ছিল না কেন তারা এটা করেছিল অথবা এটা কার ধারণা ছিল। কিন্তু শাদা কাপড়টি পুড়ে রক্ত শোঁ শোঁ করে উঠলে যে গভীর তৃপ্তি সে পেয়েছিল সেই অনুভবটি সে মনে করতে পারে। যেন-বা কোনও বাক্যহীন প্রথা পালিত হয়েছিল।

তারা ধরা পড়েনি। তবে তখন তাদের ক্যাম্পের নিয়ম লঙ্ঘনে কদাচিৎ তারা ধরা পড়ত। লুসির এমন বড় বড় চোখ ছিল। আর সে ছিল এমন পাকা মিথ্যাবাদী।

এ বছর লুসি আবার ভিন্ন। আরও ধীর গতির, আরও অবসন্ন। অন্ধকার নামার পর কাউন্সেলরের কাছ থেকে সিগারেট চুরি করার জন্য, কালো বাজারের চকোলেটের জন্য আশপাশে সন্তর্পণে ঘুর ঘুর করতে সে আর আগ্রহী না। সে বেদনাক্লিষ্ট। আর সকালে তাকে ঘুম থেকে জাগানো কঠিন। তার সৎ বাবাকেও সে পছন্দ করে না। কিন্তু তার আসল বাবার সাথেও থাকতে চায় না। তারও যে নতুন বউ আছে। সে ভাবে যে, তার মায়ের সম্ভবত এক ডাক্তারের সাথে সম্পর্ক চলছে। তবে নিশ্চিত করে জানে না সে। যদিও ড্রাইভওয়ে যাওয়ার পথে ডাক্তারের গাড়িতে তাদের দুজনকে মাখামাখি করতে দেখেছে। সেই সময় তার সৎ বাবা সেখানে ছিলেন না। উচিৎ শিক্ষা হয়েছে। লুসির প্রাইভেট স্কুল আছে। ছেলেবন্ধু আছে, যার বয়স ষোল এবং যে কাজ করে মালীর সহকারি হিসেবে। এভাবেই ছেলেবন্ধুর সাথে বাগানে তার দেখা হয়। ছেলেবন্ধুটি যখন তাকে চুমু খায় তখন তা কিসের মতো সেটা সে লোয়াসের কাছে বর্ণনা করে। প্রথমে রবারের মতো লাগে। কিন্তু তারপর হাঁটুদুটো দিয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলতে হয়। ছেলেবন্ধুটির সাথে দেখা করা তার জন্য নিষিদ্ধ হয়েছিল। আর বোর্ডিং স্কুল নিয়ে হুমকি দেওয়া হয়েছিল। বাসা থেকে পালাতে চায় সে।

প্রতিদান হিসেবে দেওয়ার মতো লোয়াসের তেমন কিছু নেই বললেই চলে। তার নিজের জীবনটা শান্ত ও সন্তোষজনক। তবে সুখের বিষয়ে খুব বেশি কিছু একটা বলা যায় না। একটু সংকীর্ণ তৃপ্তির সাথে লুসি তাকে বলে, ‘তুমি খুব ভাগ্যবতী।‘ বিরক্তিকরও বলতে পারত, কারণ লোয়াসকে এটা তেমনই বোধ করায়।

ক্যানো নৌকায় ভ্রমণ সম্পর্কে লুসি উদাসীন থাকে। লোয়াসকে তাই নিজের উত্তেজনা গোপন করে রাখতে হয়। যে সন্ধ্যায় তাদের চলে যাওয়ার কথা, সেই সন্ধ্যায় লোয়াস ক্যাম্পফায়ার বলয়ের মধ্যে অলসভাবে পড়ে থাকে, যেন জবরদস্তি করা হয়েছে। আর সহ্যের দীর্ঘশ্বাস ফেলে বসে পড়ে, ঠিক লুসি যেমনটা করে।

ক্যাম্প থেকে যাত্রা করা প্রতিটি ক্যানো ভ্রমণের জন্য ক্যাপি, সেকশন লিডার ও কাউন্সেলররা বিশেষভাবে বিদায় জানাত। সাথে থাকত পুরো সেকশনের সবাই। ক্যাপি তার দু’গালে লিপস্টিক দিয়ে তিনটা করে লাল দাগ আঁকত। দাগগুলো দেখাত তিন নখরের ছাপের মতো। ফাউন্টেন কলমের কালি দিয়ে কপালে একটা নীল বৃত্ত আঁকত। এঁকে মাথার চারপাশে রুমাল ভাঁজ করে বাঁধত। এর চারদিকে এক সারি নাজুক পালক গুঁজে দিত। আর কালো-লাল হাডসন’স বে কম্বলে নিজেকে জড়িয়ে রাখত। কাউন্সেলররাও কম্বল পরে থাকত। কিন্তু দুটো লাল দাগ থাকত, টমটম ড্রাম বাজত। টমটমগুলো কাঠের তৈরি গোল পনির বাক্সের হত, যেগুলোর ওপরে চামড়া বসানো থাকত এবং পেরেক দিয়ে আটকানো থাকত। ক্যাপি ছিল চিফ ক্যাপিওসোটা। তাদের সবাইকে বলতে হত, ‘কীভাবে!’, যখন সে হেঁটে বলয়ে ঢুকে এক হাত তুলে দাঁড়িয়ে থাকত।

পিছনে ফিরে তাকালে এ বিষয়টাকে লোয়াসের অস্বস্তিদায়ক ঠেকে। ইন্ডিয়ানদের সম্পর্কে সে খুব বেশি জানে। এ কারণে সে যেমন জানে যে, তাদেরকে ইন্ডিয়ান বলাও ঠিক না। আরও জানে যে, তাদের মতো করে পোশাক-আশাক না পরলে ও তাদের নাম গ্রহণ না করলে সেটা নিয়ে তাদের যথেষ্ট দুশ্চিন্তা হয়। এসব এক রকম চুরির ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।

কিন্তু লোয়াসের এও মনে আছে যে, এক সময় এ সম্পর্কে অজ্ঞ ছিল সে। এক সময় সে ক্যাম্পফায়ার ভালোবাসত। ভালোবাসত মুখের মধ্যে ক্যাম্পফায়ারের আলোর লকলকিয়ে গোল হয়ে পড়া, মেকি টম-টম ড্রামের আওয়াজ যা ভীত-সন্ত্রস্ত হৃদস্পন্দনের মতো ভারি ও দ্রুত হত। ভালোবাসত লাল কম্বল ও পালকে জড়ানো ক্যাপিকে, যে ছিল গুরুগম্ভীর—একজন প্রধানের যেমন হওয়া উচিৎ– যে তার হাত তুলে ধরে বলত, ‘অভিবাদন, আমার র্যাভেন।‘ এটা কৌতূকের বিষয় ছিল না। ছিল না মস্করা করাও। সে ইন্ডিয়ান হতে চেয়েছিল। দুঃসাহসিক ও নিখাদ এবং আদিবাসী হতে চেয়েছিল।

ক্যাপি বলে, ‘বিশাল জলের ওপর দিয়ে তোমরা যাও।‘ ইন্ডিয়ানরা কীভাবে কথা বলে সে ধারণাটা তার—তাদের সব ধারণাই। ‘কোনও মানুষের পা যেখানে পড়েনি, সেখানে তোমরা যাও। তোমরা অনেক চান্দ্রমাস ধরে যাও।‘ এটা সত্য না। তারা তো কেবল এক সপ্তাহের জন্য যাচ্ছে, অনেক চান্দ্রমাস ধরে না। ক্যানোর পথ স্পষ্টভাবে চিহ্নিত করা আছে। মানচিত্রে তারা এ পথ ধরে গেছে। আর বছরের পর বছর ধরে ব্যবহৃত নামের তৈরি ক্যাম্প এলাকা আছে। কিন্তু লুসির চোখ রাঙানো সত্ত্বেও ক্যাপি যখন তা বলে, লোয়াস তখন অনুভব করে যে, জলরাশি প্রসারিত হচ্ছে, তীরগুলো উভয় পাশে মোচড়াচ্ছে। প্রকাণ্ড ও একটু ভীতিকর।

ক্যাপি বলে, ‘তোমরা খুব ওয়ামপাম ফেরত নিয়ে আসো। যুদ্ধে ভালো করো, সাহসী যোদ্ধারা, আর অনেক খুলি দখল করো। এটা ক্যাপির আরেক ভান। সেটা হচ্ছে তারা ছেলে এবং রক্তপিপাসু। কিন্তু ‘স্ক’ (আমেরিকান আদিবাসী নারী) শব্দটিকে বদলিয়ে দিয়ে এমন খেলা খেলা যায় না। এতে মোটেও কাজ হবে না।

তাদের প্রত্যেককেই দাঁড়িয়ে পা বাড়াতে হয় এবং ক্যাপির দ্বারা গালে লাল রেখা টানিয়ে নিতে হয়। তাদেরকে সে বলে যে, পূর্বসূরীদের পথ অবশ্যই অনুসরণ করতে হবে তাদের (অ্যাপার্টমেন্টের জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে এবং মায়ের ড্রেসিং টেবিলের ওপর রাখা দাগেরোটাইপ ও সেপিয়া রঙের পারিবারিক প্রতিকৃতির স্তূপ, আঁটসাঁট শার্ট, কালো কোট, গম্ভীর-মুখো পুরুষ এবং সাদা-মাটা চুল ও করসেট আন্ডাওয়্যার পরিহিত সম্মানিত নারীর কথা মনে করে লোয়াস ভাবে, এরা নিশ্চয়ই ক্যানোতে করে উন্মুক্ত জলাশয়ে নিছক মজা করার জন্য কখনও অগ্রসর হত না।)

অনুষ্ঠানের শেষে তারা সবাই দাঁড়িয়ে গিয়ে গোল হয়ে পরস্পরের হাত ধরেছিল এবং গান গেয়েছিল। লোয়াস ভাবে, শব্দটা খুব ইন্ডিয়ান লাগেনি। লেগেছিল ছবিতে, সামরিক ঘাঁটিতে বিউগলের ডাকের মতো। তবে সঙ্গতি কিংবা প্রত্নতত্ত্ব নিয়ে কখনও তেমন উদ্বিগ্ন ছিল না ক্যাপি।

পরের দিন সকালে নাস্তার পর তিন জন করে চারটা ক্যানো নৌকায় চড়ে মূল ডক থেকে যাত্রা করে। লিপস্টিকের দাগগুলো তখনও পুরোপুরি উঠে যায়নি। বরং সেরে ওঠা পোড়ার মতো একটু গোলাপি দেখাচ্ছে। রোদের কারণে শাদা ডেনিম নৌ-হ্যাট, পাতলা ডোরাকাটা টি-শার্ট ও পাড়গুলো গুটিয়ে ঢিলেঢালা বিবর্ণ শর্টস পরে তারা। গুটিয়ে রাখা ঘুমের ব্যাগটিতে পাছা ঠেকিয়ে মাঝখানের জন হাঁটু গেড়ে বসে। তাদের সাথে যে কাউন্সেলররা যাচ্ছেন তারা হলেন প্যাট ও কিপ। কিপ বাজে না। আর প্যাটকে ফুসলানো কিংবা বোকা বানানো বেশি সহজ।

পেঁজো তুলোর ন্যায় মেঘ করছে। মৃদুমন্দ বাতাস বইছে। ছোট ছোট ঢেউগুলো ঝিলিক মারছে। একে অপরকে পানি ছিটাচ্ছে তারা। শিলা ও এবড়ো-থেবড়ো বৃক্ষের প্রথম লম্বা স্থানবিন্দুর পিছনে ক্যাম্পটি অদৃশ্য হয়ে গেছে। লোয়াসের মনে হচ্ছে যেন অদৃশ্য একটা রশি ছিড়ে গেছে। আলগা হয়ে নিজের মতো করে তারা মুক্তভাবে ভেসে বেড়াচ্ছে। ক্যানোর নিচে জলাশয়টি নিচে চলে গেছে গভীরতর ও শীতলতর অবস্থায়। এক মিনিট আগেও যা ছিল না।

কিপ বলেন, ‘ক্যানোতে চড়ে বোকামি করো না।‘ টি-শার্টের হাতাদুটো গুটিয়ে কাঁধ পর্যন্ত তুলে রেখেছেন তিনি। তার বাহুদুটো বাদামি ও পেশিবহুল। চোয়াল দৃঢ়। তার দাঁড় টানা নিখুঁত। তাকে এমন দেখাচ্ছে যেন তিনি জানেন ঠিক কী করতে যাচ্ছেন তিনি।

ক্যানো চারটি একসঙ্গে কাছাকাছি থাকে। তারা গায় কর্কশভাবে, স্পর্ধাভরে। গায় ‘দ্য কোয়ার্টারমাস্টার’স স্টোর’ এবং ‘ক্লিমেন্টাইন’ ও ‘আলুয়েত’। গান গাওয়ার চেয়ে এটা যেন বেশি চিৎকার-চেঁচামেচি করার মতো।

তারপর বাতাস আরও শক্তিশালী হয়। নৌকার অগ্রভাগের সাথে আড়াআড়ি বয়। আর তারা তাদের সব শক্তি ব্যয় করে নিজেদেরকে পানির মধ্যে ঠেলে নিয়ে আসে।

কোনও কিছু কি গুরুত্বপূর্ণ ছিল? পরে কী ঘটেছিল তার কোনও ধরণের কারণ বা তথ্য বাতলে দেওয়ার মতো কোনও কিছু? লোয়াসের সব কিছুই মনে আছে পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে। কিন্তু এতে তার কোনও লাভ হয় না।

সাঁতার ও মধ্যাহ্নভোজনের জন্য তারা দুপুরে বিরতি দিয়েছিল। আর বিকেল বেলা যাত্রা শুরু করেছিল। অবশেষে তারা লিটল বার্চে পৌঁছেছিল। রাতের জন্য এটাই প্রথম ক্যাম্প এলাকা ছিল। লোয়াস ও লুসি আগুন তৈরি করেছিল। আর অন্যরা ভারি ক্যানভাসে তাঁবু গেড়েছিল। অগ্নিস্থানটি ইতোমধ্যেই সেখানে ছিল। সমতল পাথরগুলি জড়ো করে ইউ. এ. পোড়া টিনের পাত্রে ভরানো হয়েছিল। আর একটা বিয়ারের বোতল এর মধ্যে রাখা হয়েছিল। তাদের আগুন নিভে গিয়েছিল। আর আবার তাদের আগুন ধরাতে হয়েছিল। কিপ বলেছিলেন, ‘তাড়াতাড়ি করো। ক্ষুধায় মরে যাচ্ছি।‘

বেলা অস্ত গিয়েছিল। সূর্যাস্তের গোলাপি আলোয় দাঁত মেজে তারা জলাশয়ের মধ্যে টুথপেস্ট থু করে ফেলে দিয়েছিল। পাত্রগুলোতে যে যে খাবার ছিল না সেগুলো ব্যাকপ্যাকে রেখে কিপ ও প্যাট ব্যাগটি গাছে ছুঁড়ে মেরেছিলেন। যদি ভাল্লুক আসে!

তাঁবুতে ঘুমাচ্ছিল না লোয়াস ও লুসি। তাদের আবেদনের প্রেক্ষিতে বাইরে ঘুমানোর অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। তাতে করে অন্যরা শুনতে পাবে না তারা কী কথা বলছিল। তারা কিপকে কথা দিয়েছিল, যদি বৃষ্টি হয় তাহলে চুরি করে তাঁবুতে গিয়ে সবার পায়ের ওপর আছাড় খাবে না তারা। নৌকার নিচে গিয়ে থাকবে তারা। এই শর্তে তারা বাইরে গিয়ে থেকেছিল।

ঘুমানোর ব্যাগের ভেতরে লোয়াস আরাম খুঁজতে চেষ্টা করেছিল। এ ব্যাগটি থেকে আগের ক্যাম্পারদের গুমোট গন্ধ বের হয়েছিল। বাসি লোনা মিষ্ট গন্ধ বের হয়েছিল। সোয়েটারটি বালিশ হিসেবে মাথার নিচে গুঁজে দিয়ে এবং টর্চলাইটি যাতে গড়িয়ে গড়িয়ে পড়ে না যায় সেজন্য ব্যাগের ভেতরে রেখে সে কোঁকড়া হয়ে শুয়ে পড়েছিল। হাতের ক্ষত স্থানের পেশিগুলো ছোট-খাটো শব্দ করছিল। যেন রাবার ব্যান্ড ভেঙে যাচ্ছিল।

তার পাশে খস খস আওয়াজ করছিল লুসি। তার শাদা চিক চিক করা ডিম্বাকৃতির মুখখানি দেখতে পেয়েছিল লোয়াস।

লুসি বলেছিল, ‘আমার পিঠে পাথর লাগছে।‘

লোয়াস বলেছিল, ‘আমারও। তাঁবুর ভেতরে যেতে চাও নাকি?’

লোয়াস নিজে যেতে চায়নি। কিন্তু জিজ্ঞেস করাটা ঠিক কাজ ছিল।

লুসি বলেছিল, ‘না।‘ ঘুমানোর ব্যাগের ভেতরেই সে শান্ত হয়ে শুয়েছিল। একটু পরে বলেছিল, ‘ফিরে না যাওয়াটাই ভালো কাজ হবে।‘

লোয়াস বলেছিল, ‘ক্যাম্পে?’

লুসি বলেছিল, ‘শিকাগোতে। ওখানে আমার একদম ভালো লাগে না।‘

লোয়াস বলেছিল, ‘তোমার ছেলেবন্ধুর খবর কী?’ লুসি কোনও উত্তর করেনি। সে হয় ঘুমিয়ে পড়েছিল নয় ঘুমানোর ভান করছিল।

চাঁদ উঠেছিল। গাছগুলো নড়াচড়া করছিল। আকাশে তারা ছিল। স্তরের পর স্তর তারা জ্বলছিল তো জ্বলছিল। কিপ বলেছিলেন যে, আবছা না হয়ে তারাগুলো যখন উজ্জ্বল হয়ে জ্বলে তার মানে সামনে খারাপ আবহাওয়া হবে। জলাশয়ে বের হয়ে ছিল দুটো লুন হাঁস। তারা উম্মত্ত, শোকার্ত কণ্ঠে একে অপরকে ডাকাডাকি করছিল। এ সময় তাদের ডাককে শোকের মতো লাগে না। শুধু পটভূমির মতো লাগে।


১ম পর্ব                                                                                                               শেষ পর্ব

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*