ডেথ বাই ল্যান্ডস্কেপ – অনুবাদ

গল্প

ডেথ-বাই-ল্যান্ডস্কেপ

ডেথ বাই ল্যান্ডস্কেপ

মূল: মার্গারেট এটউড

অনুবাদ: সেলিম মিয়া


ছেলেগুলো এখন যেহেতু বড় হয়ে গেছে, আর রব মারা গেছে, সেহেতু লোয়াস পানির পার্শ্ববর্তী নতুন ভবনগুলোর একটা কন্ডোমিয়াম এ্যাপার্টমেন্টে এসে উঠেছে। তার স্বস্তি এখানেই যে, বাড়ির চত্বর নিয়ে কিংবা ইটের দেয়ালে আইভি লতার পেশিবহুল ছোট ছোট অঙ্কুরে ছেঁয়ে যাওয়ার ব্যাপারে, অথবা কামড়ে কামড়ে কাঠবিড়ালির চিলেকোঠায় গিয়ে দেয়ালের তারের ইনুসলেশন খেয়ে ফেলার ব্যাপারে, কিংবা বিদঘুটে আওয়াজ নিয়ে তাকে দুশ্চিন্তা করতে হবে না। এ ভবনে নিরাপত্তা ব্যবস্থা আছে। আর উদ্ভিদ বলতে আছে শুধু কাচে ঘেরা কক্ষের পাত্রে।

লোয়াসের আনন্দ লাগছে যে, তার ছবি রাখার মতো যথেষ্ট বড় একটা অ্যাপার্টমেন্ট খুঁজে পেয়েছে সে। ছবিগুলো বাড়িতে যেভাবে ছিল তার চেয়ে বেশি ঠাসাঠাসি করে আছে। কিন্তু এতে ইউরোপিয়ান একটা একটা চেহারা পেয়েছে। একটা ছবি সোফার ওপরে, একটা অগ্নিচুল্লির ওপরে, একটা সামনের হলরুমে না রেখে, বরং পাশাপাশি ও ওপরে রেখে ছবির ব্লক বানিয়ে একটুখানি শিল্পের পুরান গ্রহণযোগ্য উপায়ে সাজানো, যাতে করে খুব বেশি চোখে পড়ার মতো সরাসরি না হয়। এভাবে সাজিয়ে রাখলে বেশি প্রভাব পড়ে। আপনারা তো জানেন যে, এগুলো দিয়ে আসবাবপত্র হওয়ার কথা না।

কোনও ছবিই খুব বড় নয়। তার মানে এই না যে, সেগুলো মূল্যহীন। ছবিগুলো তো পেইন্টিং, কিংবা স্কেচ এবং ড্রয়িংয়ের ছবি। লোয়াস যখন ছবিগুলো কিনতে শুরু করেছিল, তখন যেমন শিল্পীদের নাম খুব একটা জানত না এখনও তেমন জানে না। তাদের কাজগুলো পরে ডাকটিকিটে কিংবা হাই স্কুলের অধ্যক্ষের অফিসে সিল্ক-স্ক্রিন রিপ্রডাকশন হিসেবে কিংবা জিগসো ধাঁ-ধাঁয় অথবা বড়দিনের উপহার হিসেবে কম গুরুত্বপূর্ণ মক্কেলদের কাছে কর্পোরেশনের পাঠানো সুন্দরভাবে ছাপানো ক্যালেন্ডারে দেখা যেত। এই শিল্পীরা মূলত ত্রিশ ও চল্লিশের দশকে আঁকাআঁকি করত। ভূ-দৃশ্য আঁকত। লোয়াসের কাছে টম টমসনের আঁকা দুটি, এ. ওয়াই. জ্যাকসনের তিনটি, লরেন হ্যারিসের একটি ছবি আছে। আর্থার লিজমারেরও একটি ছবি আছে। আছে জে. ই. এইচ. ম্যাকডোনাল্ডের একটি ছবি, ড্যাভিড মিল্নের একটি ছবি। ছবিগুলো গোলাপি, ঢেউ-বিধৌত মসৃণ পাথরের একটা দ্বীপে গাছের কুণ্ডলিত গুঁড়ির। এ দ্বীপের পিছনেও আরও দ্বীপ আছে। অমসৃণ, উজ্জ্বল, কাঠের বিক্ষিপ্ত শৃঙ্গের একটা জলাশয়ের ছবি আছে। ঝোঁপ-ঝাড় ও তীরে নোঙর করা একটা লাল, একটা ধূসর ক্যানো নৌকাসহ জীবন্ত একটি নদীতীরের ছবি আছে। জড়িয়ে থাকা ডালপালার মধ্য দিয়ে অর্ধ-দৃশ্যমান একটা পুকুরের বরফ-নীল আভার হলুদ শারদ বনের ছবি আছে।

লোয়াস অবশ্য ছবিগুলো বাছাই করে আনেনি। আর শিল্পে রবের কোনও আগ্রহ ছিল না, যদিও দেয়ালে কিছু একটা থাকার প্রয়োজনীয়তাটা সে দেখতে পেত। সাজানো-গুছানোর সব সিদ্ধান্ত সে লোয়াসের ওপর ছেড়ে দিয়েছিল। টাকাটা অবশ্য সে-ই দিয়েছিল। লোয়াসের এই সংগ্রহের জন্য বন্ধু-বান্ধবীরা, বিশেষ করে পুরুষ বন্ধুরা বলে থাকে যে, শিল্প বিনিয়োগের ক্ষেত্রে তার ভালো একটা রুচি আছে।

তবে ছবিগুলো সেই আগে এ জন্য কেনেনি লোয়াস। কিনেছিল সেগুলো চেয়েছিল বলে। এমন কিছু চেয়েছিল যা ছবিগুলোর মধ্যে ছিল, যদিও সে সময় সে বলতে পারত না সেটা কী ছিল। তবে শান্তি ছিল না এটা। ছবিগুলো তার কাছে মোটেও শান্তিপূর্ণ লাগে না। তাকালে এক ধরণের নিঃশব্দ অস্বস্তিতে ভরে যায় সে। ছবিগুলোর মধ্যে কোনও মানুষ কিংবা প্রাণীও যে নেই তা সত্ত্বেও মনে হয় কিছু একটা আছে, অথবা কেউ একজন আছে যে পিছনে তাকিয়ে আছে।

তের বছর বয়সে লোয়াস ক্যানো ভ্রমণে গিয়েছিল। আগে শুধু রাতের বেলা যেত। ক্যাপির ভাষায় ভ্রমণটা ছিল লম্বা, পথহীন তেপান্তরের মধ্যে। ভ্রমণটা ছিল লোয়াসের জন্য প্রথম এবং ক্যাপির জন্য শেষ।

ক্যাপি ছিল গ্রীষ্মকালীন ক্যাম্পের প্রধান। এ ক্যাম্পেই নয় বছর বয়স থেকে লোয়াসকে পাঠানো হচ্ছিল। ক্যাম্পটির নাম ছিল ম্যানিটো। মেয়েদের জন্য সবচেয়ে ভালো না হলেও অপেক্ষাকৃত ভালো ক্যাম্পগুলোর একটি ছিল এ ক্যাম্পটি। তার বয়সী মেয়েদের, যাদের বাবা-মায়ের সামর্থ্য ছিল, তাদেরকে নিয়মিতভাবে এমন সব ক্যাম্পে বোঁচকাসহ পাঠানো হত। ক্যাম্পগুলোর একটার সাথে আরেকটার সাধারণ মিল ছিল। নামগুলো হত ইন্ডিয়ান, আর নেতারা হত উদ্যমী ও প্রফুল্ল মেজাজের। এদেরকে বলা হত ক্যাপি বা স্কিপ কিংবা স্কটি। এসব ক্যাম্পে ভালোভাবে সাঁতার কাটা ও নৌকা চালনা করা, পাল তোলা, এবং সম্ভবত ঘোড়ায় চড়া কিংবা টেনিস খেলা শেখানো হত। এসব জিনিস না হলে চারু ও কারু শিল্প চর্চা করে মায়ের কাছে মেয়েরা নোংরা, বিদঘুটে কাদার ছাইদানিতে পরিণত হত। মায়েরা তখন বেশি ধূমপান করতেন। কিংবা রঙিন তারে বোনা চুড়ি পড়তেন।

প্রফুল্ল ভাবের দরকার হত সব সময়। নাস্তার সময়ও। উচ্চ কলরোল এবং টেবিলে চামচের টুং টাং অনুমোদিত ছিল। রীতিমাফিক বিরতিতে উৎসাহিতও করা হত। দাঁতের ক্ষয় ও ব্রুণ ঠেকাতে চকোলেট খাওয়া সীমিত পর্যায়ে রাখা হত। নৈশভোজনের পর রাতের বেলা ডাইনিং হলে কিংবা বিশেষ ভোজনের জন্য মশা উপদ্রুত ক্যাম্পফায়ার বলয়ের চারপাশের বাইরে সমস্বরে গান গাওয়া হত। ‘মাই ডারলিং ক্লিমেন্টাইন’ এবং ‘মাই বনি লাইজ ওভার দি ওশান’ গানের সব কথা অঙ্গভঙ্গিসহ এখনও মনে আছে তার। যেমন—সমুদ্রের জন্য হাতদুটো ঢেউ খেলানো, মিথ্যা কথার জন্য গালের নিচে দু’হাত রাখা। সে কখনই এসব ভুলবে না, যা বিষাদিত একটা ভাবনা।

লোয়াস ভাবে, এসব ক্যাম্পে যেসব নারী যেত তাদেরকে সে চিনতে পারবে। আর চেনার কাজটা বেশ ভালো পারত সে। এখনও তাদের করমর্দনের একটা কাঠিন্য আছে। যেমন—পাগুলো স্বাভাবিকের তুলনায় বেশ দূরে আলাদা করে শক্তভাবে রেখে দাঁড়িয়ে থাকার ভঙ্গি, ক্যানো নৌকার সামনে নাকি পিছনে আপনার অবস্থানটা ভালো হবে তা আপনাকে দেখে বলে দেওয়ার উপায়। তারা নিজেরা পিছনে থাকত। একে তারা বলত পশ্চাদভাগ।

লোয়াস জানে যে, এমন ক্যাম্পের অস্তিত্ব এখনও আছে, যদিও ক্যাম্প ম্যানিটো নেই। এ ক্যাম্পগুলো এমন অল্প কিছু জিনিসের মধ্যে একটা, যার পরিবর্তন তেমন একটা হয়নি। ক্যাম্পগুলোতে এখন তামার এনামেলিং করা আছে। বৈদ্যুতিক চুল্লিতে সেঁকা স্টেইনড গ্লাসের কার্যক্রমবিহীন টুকরো আছে, যদিও তার বন্ধু-বান্ধবীর নাতি-নাতনিদের উৎপাদনের দিক থেকে বিচার করলে বলা যায় শৈল্পিক মানের উন্নতি ঘটেনি।

লোয়াসের মতে যুদ্ধের পর প্রথম বছরে এর সম্মুখীন হলে ক্যাম্প ম্যানিটোকে পুরাতন মনে হত। আধা-কাঠের মধ্যে শাদা সিমেন্ট দিয়ে তৈরি ক্যাম্পের কাঠ-পার্শ্বযুক্ত ভবনগুলো, এর পতাকার খুঁটিটা ধবল-ধোলাই পাথরে বেজে উঠত। এর ক্ষয়ে যাওয়া ধূসর ডকটি বেরিয়ে গিয়ে লেক প্রসপেক্টে পড়ত। সাথে থাকত বেঁধে রাখার জন্য রশি দিয়ে বোনা বাম্পার ও জং ধরা রিং। আরও থাকত অফিস দরজার কাছে অপরাজিতার পরিপাটি গোলগাল বাগিচা। সব সময়ই এগুলো থাকত। আসলে এটা ছিল শতাব্দীর প্রথম দশকের। ক্যাপির পিতামাতা এটা প্রতিষ্ঠা করেছিল। তারা ভাবত যে, শীতল জলে গোসল করার মতো চরিত্রকে চাঙ্গা করে তোলে ক্যাম্পিং। আর উত্তরাধিকার সূত্রে এবং বাধ্যবাধকতা হিসেবে এটা তার ওপর এসে বর্তেছিল।

পরে লোয়াস উপলব্ধি করেছিল যে, ক্যাম্প ম্যানিটোকে চালু রাখা ক্যাপির জন্য অবশ্যই সংগ্রামের একটা ব্যাপার হয়ে থাকবে। বিশেষ করে মন্দার সময়ে ও পরে যুদ্ধের সময়ে। এ সময় অর্থের মুক্ত প্রবাহ ছিল না। শুধুমাত্র সচ্ছলদের পরিবর্তে ক্যাম্পটি যদি খুব ধনীদের জন্য হত, তবে সমস্যা অনেক কম থাকত। কিন্তু পুরোদমে না হলেও কাজকর্ম চালানোর জন্য যথেষ্ট বুড়ো মেয়েদের অবশ্যই থাকতে হত, যাদের আবার নিজেদের মেয়ে আছে। ক্যাম্পের আসবাবপত্রগুলো জীর্ণ ছিল, কিনারার রঙ উঠে গিয়েছিল, ছাদগুলো ফুটা হয়ে গিয়েছিল। এসব বুড়ো মেয়েদের অনুজ্জ্বল আলোকচিত্র বিন্দুর মতো ছড়িয়ে ছিল ডাইনিং হলে। ছবিতে তারা পর্যাপ্তভাবে পশমি গোসলের কাপড় পরে ছিল। তাদের মোটা মোটা টোল পড়া পা দেখা যাচ্ছিল। অথবা ঢিলেঢালা স্কার্ট পরে অদ্ভূৎ টেনিস কাপড়ে হাতগুলো গুঁজিয়ে রেখে দাঁড়িয়ে ছিল।

ডাইনিং হলে অব্যবহৃত পাথরের অগ্নিস্থানে ছিল লোম পুরে দেওয়া বিশাল একটা মূসের মাথা। একে কেন যেন মাংসাসী দেখাত। এটা এক ধরণের মাস্কট ছিল। নাম ছিল মন্টি ম্যানিটো। পুরাতন ক্যাম্পাররা কাহিনি রটিয়েছিল যে, এটাকে তাড়া করা হয়েছিল এবং অন্ধকারে জীবন ফিরে পেয়েছিল, যখন নিস্প্রভ ও অনির্ভরযোগ্য বাতিগুলো নিভে গিয়েছিল কিংবা অন্য একটা জেনারেটর কাজ না করায় বাতিগুলো নিভে গিয়েছিল। লোয়াস প্রথমে ভয় পেয়েছিল। কিন্তু এতে অভ্যস্ত হয়ে যাওয়ার পর আর ভয় লাগেনি তার।


২য় পর্ব

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*