সঙ্গীত ও ফটোগ্রাফিতে রঙ

নিবন্ধ

সঙ্গীত ও ফটোগ্রাফিতে রঙ

-শাহিনুর ইসলাম


বিজ্ঞান তিনটি পৃথক ও সুস্পষ্ট দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে রঙকে বিচার করে। পদার্থ বিজ্ঞান অনুসারে রঙ হলো বিকীর্ণ শক্তি। মনোপদার্থ বিজ্ঞান অনুযায়ী রঙ হলো ভৌত উদ্দীপকের প্রতি দর্শকের অক্ষিপটের প্রতিবেদন বা প্রতিক্রিয়া এবং মনোবিজ্ঞান মতে রঙ হলো এক ধরনের চাক্ষুষ সংবেদন, যার অস্তিত্ব কেবলমাত্র মনের অস্থায়ী সচেতনতা রূপে। আমাদের নিত্যকার জীবনে তৃতীয় দৃষ্টিভঙ্গিই প্রযোজ্য। এই রঙের বিজ্ঞানের দিক  ছাড়াও রয়েছে শিল্পের দিক, সৌন্দর্যের দিক ও ঐতিহ্যের দিক।

মানুষের চাক্ষুষ অভিজ্ঞতার ক্ষেত্রে রঙ এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। রঙের মৃদুতা বা উজ্জ্বলতা মানুষ চাক্ষুষ অভিজ্ঞতায় অর্জন করে থাকে। আমাদের জীবনে রঙের ভূমিকা যে কত ব্যাপক ও বিস্তীর্ণ তা কল্পনাতীত। তাই তো  রঙকে মানুষ অধিকারী বস্তুর মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখেনি যেমন- হিন্দু ধর্মের ক্ষেত্রে ব্রাহ্মনের রঙ শাদা হিসেবে এবং ইসলাম ধর্মে সবুজ রঙকে পবিত্রতার প্রতীক হিসেবে ধরা হয়। আবার আমেরিকার কোন কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধীত বিষয়সমূহকে রঙ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। যেমন- সাহিত্য ও মানবিক কলাকে শাদা বর্ণে, অধ্যাত্মবিদ্যাকে টকটকে লাল, দর্শনকে নীল, সঙ্গীতকে গোলাপি ইত্যাদি হিসেবে কল্পনা করা হয়। আবার বাস্তব জীবনে কাউকে বেশি উচ্ছ্বাসপ্রবণ দেখলে মনে রঙ লেগেছে বলা হয়। আসলে এ সব ব্যাপার জগৎ ও জীবনের সাথে রঙের অবিচ্ছেদ্য, অপরিসীম সম্পর্ককেই ইঙ্গিত করে।

ছবিতে একখানা মেঘের রঙ যদি শাদা থাকে তবে তা শীতকাল, হালকা নীল থাকলে শরৎকাল এবং ঘন কালো রঙ থাকলে তা বর্ষাকালকেই সংচিত্রিত করে। বস্তুজগতে রঙকে যদিও আলো ও চোখের গ্রহনক্ষমতার দরুণ আপেক্ষিক হিসেবে আমরা পাই, তথাপি বস্তুজগতকে চেনা, জানা ও দেখার জন্য এর গুরুত্ব পরিমাপ করা যায় না। রঙ দেশ ও কাল এবং আবহকে ধারণ করে। উম্মুক্ত স্থানে যেখানে সরাসরি সূর্যালোক এসে পড়েছে সেখানকার তুষার যেমন শাদা বর্ণ ধারণ করে, তেমনি ছায়াচ্ছন্ন স্থানের তুষার নীল রঙকে অভিব্যক্ত করে। আবার নীল আকাশের নিচে শাদা বাড়ির দেয়াল যেমন নীলচে লাগে তেমনি হলুদ বাড়ির দেয়াল নীল আকাশের নিচে সবুজ বলে প্রতিভাত হয়। এছাড়া ঘাসের উপর সূর্যরশ্মি সরাসরি এসে পড়লে তা আসলে হলুদ বলেই মনে হবে। সূর্যালোকের হেরফেরও ছবিতে এসে ধরা পড়ে। সে কারণে সকাল বেলা ও বিকেল বেলার তোলা ছবি যেমন সোনালী হলুদ হিসেবে ধরা পড়বে, দূপুরে তোলা ছবি তেমনি নির্দিষ্ট বর্ণের cast- এ ধৃত হবে। এভাবে বর্ণবিভব দেশ, কাল ও পরিবেশকে বুঝতে অনেকখানি সহায়তা করে।

বর্ণালী পরীক্ষার মাধ্যমে জানা যায় সূর্যের শাদা আলোতে সাতটি রঙ থাকে। এদের মধ্যে প্রাথমিক রঙ হচ্ছে লাল, নীল ও সবুজ। এছাড়াও এসব রঙের যুত-বিযুত মিশ্রণের মাধ্যমে বর্ণমাত্র(hue), রঞ্জক(dye), ছোপ(tint), ছায়া(shade) এবং আভা(tone) সৃষ্টি করা যায়। তবে বলে রাখা ভালো, আলোর ক্ষেত্রে প্রাথমিক রঙ হচ্ছে লাল, নীল ও সবুজ এবং রঞ্জকের ক্ষেত্রে মূখ্য রঙ হচ্ছে লাল, হলুদ ও নীল। সব রঙের মধ্যে চিত্রকলার আদিতম রঙ হচ্ছে লাল। কবি, শিল্পী, দার্শনিক ও বিজ্ঞানীর মতে রঙ একই সাথে চোখের, মনের, বুদ্ধির ও আত্মার বিষয়।

যখন দুটি বর্ণ পাশাপাশি রাখা হয় তখন আমাদের চোখ বারবার রঙ থেকে রঙে সরে যায় ও ফিরে আসে। এর ফলে গাঢ় রঙ আরো গাঢ় এবং মৃদু রঙ মৃদুতর প্রতিভাত হয়। কারণ মৃদু রঙের দিকে তাকিয়ে থাকাকালীন চোখের সংবেদনশীলতা কম খোরাক পায়, এই অবস্থায় যখন সে গাঢ় রঙটির দিকে দৃষ্টিপাত করে তখন মৃদুতে অভ্যস্ত চোখ গাঢ়কে গাঢ়তর দেখে। আবার গাঢ় রঙের দিকে তাকিয়ে থাকাকালীন চোখের সংবেদনশীলতা বেশি খোরাক পায়। ফলে পুনরায় মৃদু রঙের দিকে দেখার সময় গাঢ়তে অভ্যস্ত চোখ মৃদুকে আরও মৃদু দেখে। তেমনি বর্ণসঙ্গতি(color harmony) ও বর্ণবৈপরীত্য(color contrast) সূত্রের বদৌলতে হলুদ ও নীল রঙকে পাশাপাশি রাখলে তারা অধিকতর সম্পৃক্ত(saturated) হিসেবে ধরা দেবে। লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি বলেছেন যে, বিভিন্ন বর্ণ দর্শকের কাছ থেকে ক্রমাগত দূরে সরিয়ে নিলে রঙের উপর বায়ুমণ্ডলের প্রভাবের ফলে রঙ থেকে রঙের প্রভেদ কমে যেতে থাকে এবং দর্শকের চোখে তা মাঝারি থেকে হালকা ধূসরের বিভিন্ন তারতম্য অনুযায়ী ধরা দেয়। তিনি আরো বলেন, রঙের বৈপরিত্যে যদি সৌন্দর্য থেকে থাকে, তবে রঙের সাদৃশ্যেও সৌন্দর্য আছে।

ছবিতে বর্ণবিন্যাস কেমন হবে তা নির্ভর করে মূলত দু’টি বিশেষ অবস্থা বর্ণসঙ্গতি ও বর্ণবৈপরীত্যের উপর। সঠিক বর্ণবিন্যাসের মাধ্যমে উদ্দীপকগুলি এমনভাবে নির্বাচিত, উপস্থাপিত ও বিন্যস্ত করতে হবে যাতে দর্শকের মনস্তত্ত্বে অনির্দিষ্টতা ও অনিশ্চয়তার অনুভূতির সঞ্চার না হয়। সে বিন্যাসে থাকবে উপাদানগুলির মধ্যকার ভারসাম্য ও ব্যবহৃত ধর্ম বা শক্তিসমূহের ভেতর যথানুপাত। বর্ণবিন্যাসকে হতে হবে বৈচিত্র্যময় ও আগ্রহোদ্দীপক, বিষয় ও আকারে অভিন্ন ভাব প্রকাশক। বর্ণবিন্যাস সাধারণত পরিপূরক বিন্যাস, সাদৃশ্যময় বিন্যাস ও একবর্ণীয় বিন্যাস হিসেবে প্রকাশ লাভ করে। একবর্ণীয় বিন্যাসে একটি মাত্র রঙ থাকলেও তার সম্পৃক্তি ও উজ্জ্বলতার সাহায্যে বর্ণবিন্যাস সৃষ্টি সম্ভব। আর বর্ণপরিপূরকতার ধারণাটি তো প্রকৃতিতেই সুস্পষ্টরূপে চিত্রিত আছে- লাল/সবুজ… নীল/হলুদ ইত্যাদি। বর্ণবিন্যাসে সমমাত্রার বর্ণবৈষম্য যেমন থাকতে পারে তেমনি তা অসম মাত্রার বর্ণষৈম্যেও থাকতে পারে; যেমন- কালো/গাঢ় বা হালকা ধূসর/শাদা, কালো/মাঝারি ধূসর/হালকা ধূসর বা গাঢ় ধূসর/মাঝারি ধূসর/শাদা ইত্যাদি। উপাদানের বৈপরীত্য ব্যবহৃত উপাদানগুলিকেই আরও জোরালো করে; যেমন- নীলের পাশে কমলা থাকলে কমলার উষ্ণতাকেই তীব্র করে। জোরালো নীল-সবুজ পটভূমিতে সুতীব্র রঙের উপস্থিতির বর্ণবিন্যাসকে আরো দীপ্তিময় করে তোলে। বর্ণসঙ্গতিও সঙ্গীতের ছান্দিকতা আনতে সক্ষম। বর্ণসঙ্গতি বিভিন্নভাবে সৃষ্টি করা যেতে পারে।

রঙের ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য আবেদন আছে বলেই তা ব্যবহারিক জীবন থেকে শুরু করে শিল্প-সাহিত্যে আধিপত্য বিস্তারে সক্ষম হয়েছে। ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য আবেদনের প্রেক্ষিতে বিশেষ রঙকে বিশেষ শ্রেণীতে ফেলা হয়েছে; যেমন- লাল, কমলা, হলুদকে বলা হয় উষ্ণ রঙ এবং নীল, সবুজকে বলা হয় শীতল রঙ। আবার বিভিন্ন বর্ণ ইন্দ্রিয়ের কাছে ধরা দেয় উজ্জ্বল, ফ্যাকাশে, ম্যাড়মেড়ে, স্বচ্ছ, অস্বচ্ছ, শুকনো, ভাসাভাসা কিংবা রসালো হিসেবে। রঙ মানুষকে তার নিজস্ব অনুভূতির ভাষা প্রদান করেছে এবং প্রতীকী অর্থ দিয়েছে। বিশেষ রঙ যে বিশেষ বিশেষ ভাবকে ব্যঞ্জিত করে তা দেশ-কাল-সংস্কৃতি ভেদে ভিন্ন হয়ে থাকে। তবুও কোন্ রঙ কিসের প্রতীক তার মোটামুটি গ্রহনযোগ্য একটি তালিকা দেয়া যেতে পারে। যেমন-

শাদা- পবিত্রতা, শুভ্রতা, আশা, সেবা, শান্তি, জ্ঞান, বিশ্বাস, আধ্যাত্মিকতা, আভিজাত্য।

কালো- কুশ্রীতা, বিকৃতি, ক্ষুদ্রতা, মলিনতা, নিরাশা, দুঃখ, শোক, ধ্বংস।

লাল- প্রেম, আনন্দ, সৌন্দর্য, বিপ্লব, আশা, জীবন।

হালকা নীল- সহনশীলতা, রোমাণ্টিসিজম, অসীমতা, জ্ঞান।

গাঢ় নীল- ভয়, অস্বস্তি, উদ্বেগ, হিংস্রতা, বদমাইশী, ধবংস।

সবুজ- প্রকৃতি, প্রাণ, মুক্তি, বিশালতা, জীবন, সততা, তারুণ্য।

হলুদ- জ্ঞান, তাপ, প্রজ্ঞা, আশ্বাস। আবার ভয়, নৃশংসতা, হিংসা, প্রতারণা, অবিশ্বাস,

        কাপুরুষতা, যৌনতাজাত পাপ।

বেগুনি- হতাশা, শোক, নির্জীবতা।

বাদামী- মন্থরতা, ঔদাসিন্য।

কমলা- উষ্ণতা, আলো, প্রেম, উৎসাহ।

হালকা ধূসর- ঔদাসিন্য।

ভারী ধূসর- হতাশা, বিষাদ।

ম্যাজেণ্টা- রহস্যময়তা।

রঙীন আলোকচিত্রণে রঙ হচ্ছে প্রধান শক্তি এবং একই সাথে একটি বড় সমস্যা। রঙীন ছবিতে শাদা-কালো ছবির তুলনায় প্রকাশযোগ্যতা ও বাঙময়তা বেশি। তা অনুভূতিকে বিচিত্র রঙে অভিব্যক্ত করার ক্ষমতা রাখে। তবে ছবিতে প্রক্ষিপ্ত রঙ যদি বাস্তব জীবনের সঙ্গে কম সাদৃশ্যপূর্ণ হয়, তাতে ক্ষতি নেই। কারণ রঙ শুধু বাস্তবের রঙকেই অনুসরণ করে না, তা ভাব-অনুভাবের রঙকেও অনুসরণ করে। ফলে প্রকাশময়তা আরো বাঙময় হয়ে ওঠে বা অপ্রকাশযোগ্যকে প্রকাশময়তা প্রদান করে।

রঙীন আলেকচিত্রে আলোর বর্ণের যুত মিশ্রণ এবং রাসায়নিক রঙে রঞ্জিত বস্তুবর্ণে রঙের বিযুত মিশ্রণ- একই সঙ্গে এ দুই মিশ্রণের সাক্ষাৎ মেলে। আবার নান্দনিক দিক থেকে দেখলে রঙীন ছবির ত্রিমাত্রিক জগতের বর্ণমাত্র(hue), ঔজ্জ্বল্য ও সম্পৃক্তিকে(saturation) শাদা-কালো ছবি পর্যবসিত করে ধূসর রঙের একমাত্রিকতায়, সেই মাত্রাটি হলো উজ্জ্বলতার। ফলত, দৃশ্যমানের সংখ্যা হ্রাস পায় এবং সংরচনের শৃঙ্খলা ও তীক্ষ্মতা আনা অপেক্ষাকৃত সহজ হয়। রঙিন ছবিতে সে সুযোগ কম, সেখানে সংরচনকে সুসংহত ও সামঞ্জস্যপূর্ণ করে তোলা বেশ কঠিন। কিন্তু এ জটিলতাকে কাটিয়ে উঠতে পারলে রঙিন আলোকচিত্র শিল্পকর্ম হিসেবে সমৃদ্ধি লাভ করে। রঙীন ছবিতে রঙের উপস্থিতি দর্শকের মনে নানা আবেগের জন্ম দেয়- যা শাদা-কালো ছবিতে আশা করা যায় না। তাই রঙ ছবিতে এমনভাবে রাখা উচিত যা সঙ্গীতের ছন্দময়তা ও সুরময়তা নিয়ে দর্শকের কাছে হাজির হয়। অবশ্য রঙের ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য আবেদনের ভিন্নতা দেশ-কাল ভেদে ভিন্ন হওয়ায় তা শেষ পর্যন্ত আত্মগত(subjective) হিসেবে ধরা দেয়। অন্যদিকে শাদা-কালো ছবির এই ধর্মের অনুপস্থিতির দরুণ তা বস্তুনিরপেক্ষ(objective) হিসেবে প্রতিভাত হয়।

এখন দেখা যাক, সঙ্গীতে বর্ণ কিভাবে বিরাজ করে। সঙ্গীতে রঙ বা বর্ণ থাকে স্বর হিসেবে। সপ্তকের যে সাতটি শুদ্ধ স্বর- স, র, গ, ম, প, ধ, ন- তাকেই আলোর সাতটি রঙ- বেগুণী, নীল, আসমানী, সবুজ, হলুদ, কমলা, লাল- এর সাথে তুলনা করা যায়। সঙ্গীতে স্বরগ্রামের শুদ্ধ ও বিস্তৃত স্বর মিলে যেমন সুরসঙ্গতি তৈরি করে তেমনি রঙীন আলোকচিত্রে ঐ সব রঙের বর্ণ-সঙ্গতি ও বর্ণবৈপরীত্য এ দুই বর্ণবিন্যাসের সাহায্যে সঙ্গীতের সেই ছন্দ বা সুরকে ধরা যায়। তখন সেই ছবি সঙ্গীতের সুর ও ছন্দের যে গতিময়তা ও অন্তর্লীন টানাপোড়েন তাকে উপস্থিত করে দর্শকের সামনে- যা দর্শককে আপ্লুত ও রসসিক্ত করে ভিন্ন আমেজ ও মেজাজের সন্ধান দেয়।

কান্দিন্স্কি রঙ ও শব্দ বা সঙ্গীতের মধ্যে সাদৃশ্য ও সংযোগ খুঁজে পেয়েছিলেন। তিনিই রঙের সঙ্গীতের (যেমন- ‘হলুদের সঙ্গীত’) প্রথম বক্তা। এই হলুদ ধ্বনি হচ্ছে রঙ এবং সঙ্গীত সম্পর্কে তাঁর অনুভূতির দৃশ্যরূপের একটি প্রক্রিয়া। আবার যদিও সঙ্গীতজ্ঞ থেকে সঙ্গীতজ্ঞে মতবিভেদ ঘটে তথাপি কোন কোন সঙ্গীতবিশারদ বাঁশির সুরকে তুলনা করেছেন গাঢ় আকাশী নীলের সাথে, ওবোরকে স্বচ্ছ হলুদের সাথে, ভেরীর সুরকে টকটকে লালের সাথে, শিঙার সুরকে সবুজাভ থেকে বাদামীরঙার সাথে। ১৮৮৫ সালে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের মধ্যে গবেষণা চালিয়ে একজন নামী চক্ষু বিশেষজ্ঞ দেখেন, ৫২৬ জন ছাত্র রঙকে শব্দ হিসেবে এবং শব্দকে রঙ হিসেবে দেখে। এর ফলে তারা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে বাদামি রঙ ও বাঁশির শব্দের মধ্যে মিল রয়েছে। মিল রয়েছে সবুজের সাথে শিঙার শব্দে। বেটোফেন নাকি বলেছিলেন, বি মাইনর হলো কালো যোজক (black key)। আর এক সঙ্গীতজ্ঞ রিমস্কি কোরসাকোভ স্বনের তীব্রতার কথায় বলেছেন কীভাবে তীক্ষ্ম বা উচ্চ স্বরগুলি তাঁর কাছে রঙের প্রভাব নিয়ে হাজির হয়, আর খাদের স্বর বা সুর কমবেশি উত্তাপের ভয়াবহতা সৃষ্টি করে। তিনি সিম্ফনির কোনো বিশেষ দৃশ্যে C-sharp minor- এর পর D-sharp major এনেছেন উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবেই- যাতে করে উত্তাপের একটা অনুভূতি আসে,  ঠিক যেভাবে লাল রঙ নিয়ে আসে তাপের সংবেদন এবং নীল ও বেগুণী-নীল আনে শীতলতা ও অন্ধকারের অনুভূতি।

এখন সঙ্গীতের সপ্তকের যে সাতটি শুদ্ধ স্বর থাকে তা ছাড়াও পাঁচটি বিকৃত স্বর থাকে। এদের দুই-য়ে মিলে আরো ২২ টি শ্রুতি থাকে। তেমনি রঙের  ক্ষেত্রে সাতটি রঙ ছাড়াও রঙের যুত মিশ্রণ ও বিযুত মিশ্রণের সাহায্যে আরো নানাবিধ হালকা বা গাঢ় রঙের সৃষ্টি সম্ভব। সুতরাং সঙ্গীতে বাস্তবজগতের রঙ থাকে চূড়ান্তভাবে বিমূর্ত আকারে, রঙীন আলোকচিত্রেই শুধু তার সরব ও সঘন প্রকাশ। আমরা যে এক ব্যক্তির কণ্ঠ থেকে অন্য ব্যক্তির কণ্ঠ শুনে পার্থক্য নির্ণয় করতে পারি তা মূলত সাঙ্গীতিক বর্ণের (টোন বা স্বর) পার্থক্যের কারণেই। তেমনটি ঘটে বলেই আমরা একই গান ভিন্ন কণ্ঠে গীত হলেও তা অনায়াসেই বুঝতে পারি। কণ্ঠস্বর শুনেই বোঝা যায় কোনটি মান্নাদের, কোনটি হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের, কোনটি লতা মুঙ্গেশকরের, কোনটি আশা ভোঁসলের কণ্ঠ। রঙের বিভিন্ন অনুষঙ্গ মাথায় রেখে আমরা বিভিন্ন কণ্ঠকে সনাক্ত করতে পারি। বাস্তবিকপক্ষে, রেখার সাথে রঙও বস্তুকে আলাদা করে চিনতে সাহায্য করে। যদি গোলাপের রঙের বিভিন্ন টোন ছবিতে ঠিকমতো চিত্রায়িত না হয় তবে গোলাপের বর্ণ ও প্রজাতি বৈচিত্র্য আমাদের কাছে ধরা পড়বে না। তেমনি একই আকৃতির বিভিন্ন পাখিকে পৃথক করে চিনতে পারি তাদের নিজ নিজ বর্ণের কারণেই। এছাড়াও বস্তুজগতে গাছের পাতার বিভিন্ন রঙ ও রঙের টোনে বিচার করে বলা যায় পাতাটি কোন গাছের এবং কোন সময়কার। কাজেই এখানেও দেখা যায় সঙ্গীতের রঙ(স্বর বা শ্রুতি) এর সাথে বস্তজগতের বর্ণসুষমা কিংবা বর্ণবিভেদের কোন তফাৎ নেই। তাই উভয়ক্ষেত্রে শুধু সঙ্গতি থাকা আবশ্যক। আবার গান-বাজনায় যে প্রত্যক্ষ ক্রিয়া তাকেও বর্ণ বলে- স্থায়ী বর্ণ, আরোহী বর্ণ, অবরোহী বর্ণ ও সঞ্চারী বর্ণ। একাধিকবার উচ্চারিত স্বরের ক্রিয়াকে স্থায়ী বর্ণ বলে, যেমন- স স স। নিচু স্বর থেকে উচু বা চড়ার দিকে বাদিত/গীত ক্রিয়াকে আরোহী বর্ণ বলে, যেমন- স র গ ম ধ ন। উচু বা চড়া সুর থেকে নিচের দিকে গীত/বাদিত ক্রিয়াকে অবরোহী বর্ণ বলে, যেমন- ন ধ ম গ র স। আর উক্ত তিনটি বর্ণ মিলে যে ক্রিয়া হয় তাকে সঞ্চারী বর্ণ বলে, যেমন- সস রগ মপ ইত্যাদি।

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*