ওয়াইল্ডারনেস টিপস – অনুবাদ

গল্প

ওয়াইল্ডারনেস টিপস

ওয়াইল্ডারনেস টিপস

মূল: মার্গারেট এটউড

অনুবাদ: সেলিম মিয়া


দুটো লাল রুমাল ভাঁজ করে ত্রিভুজ বানিয়ে এক সাথে বেঁধেছে প্রু। বেঁধে এক সেট কোণ বানিয়েছে। দ্বিতীয় সেটের কোণ তার পিছনে বাঁধা। তৃতীয়টা তার গলার চারপাশে। আরেকটা নীল রুমাল বেঁধেছে মাথার চারদিকে। বেঁধে সামনের দিকে ছোট একটা দ্বিমুখী গিট্টু দিয়েছে। উপস্থিত মতো বানানো গলরজ্জু, শাদা শর্টস, শাদা প্লাস্টিক ফ্রেমের সানগ্লাস ও প্ল্যাটফর্ম জুতা পরে এখন সে ডক বরাবর দম্ভভরে হাঁটছে।

হাত নিতম্বে রেখে ও ব্যালে নাচের ভঙ্গি করে সে জর্জকে বলে, ‘চল্লিশের দশকের সাজ এটা। রোজি দ্য রিভেটার। যুদ্ধ থেকে। মনে আছে তার কথা?’

জর্জের মনে নেই। তার আসল নাম জর্জও না। বর্জ্য স্তূপ তন্ন তন্ন করে খুঁজে এবং ভিক্ষা করে ও শিশুর অনুপোযোগী অন্য কিছু করে চল্লিশের দশকটি কেটেছিল তার। পায়খানার দেয়ালে ছেড়া ক্যালেন্ডারে ভঙ্গিমায় থাকা ছায়াছবির তারকার অস্পষ্ট স্মৃতি আছে তার। প্রু হয়ত এটাই বোঝাচ্ছে। মুহূর্তের মধ্যে জর্জের মনে পড়ে মেয়েটির উজ্জ্বল, নিস্পাপ হাসি ও সুপুষ্ট শরীরটির প্রতি তার প্রবল রাগের কথা। দুজন বন্ধু রান্না ঘরের ছুরির জং ধরা ব্লেড দিয়ে এ মেয়েটির কাছ থেকে তাকে আলাদা হতে সাহায্য করেছিল। ছুরিটা তারা পেয়েছিল ইটের খোঁয়ার মধ্যে। প্রুকে এর কোনও কিছু বলার জন্য ভাবেনি জর্জ।

সবুজ-শাদা ডোরাকাটা মোটা কাপড়ের ফোল্ডিং চেয়ারে বসে আছে সে। বসে বসে পড়ছে দ্য ফাইন্যানশল পোস্ট, আর স্কচ পান করছে। তার পাশের ছাইদানিটি সিগারেটের মোথা দিয়ে ভরে উপচে পড়েছে। তাকে ধূমপান থেকে রক্ষা করার জন্য অনেক নারীই চেষ্টা করেছে। কিন্তু ব্যর্থ হয়েছে। পত্রিকার পিছন থেকে সে প্রুর দিকে তাকিয়ে তার শিয়ালের হাসিটা হাসে। মুখের ঠিক ভেতরে রাখলে এ হাসিটা সে দেয়। ঠোঁটের দু’পাশ পিছনে কুঞ্চিত হয়। দাঁত দেখা যায়। তার লম্বা ছেদন দাঁত আছে, অলৌকিকভাবে এখনও যা তার।

সে বলে, ‘তখন তোমার জন্ম হয়নি।‘ এ কথা সত্য নয়। কিন্তু যখন মিথ্যে বলার সুযোগ থাকে, তখন প্রশংসা করার সুযোগটা সে কখনও হাতছাড়া করে না। কত দাম পড়ে? এক পয়সাও না। এটাই এ দেশের পুরুষগুলো কখনই বোঝেনি। প্রুর তামাটে তলপেট জর্জের মুখাবয়বে এসে পড়ে। এখনও তা দৃঢ়, এখনও নমনীয় এবং কমনীয়। এ বয়সে জর্জের মা নরম হয়ে গিয়েছিল—চামড়া ঝুলে পড়েছিল এবং বয়োবৃদ্ধ কূল গাছের মতো মখমল-নরম হয়েছিল। আজকাল তারা প্রচুর শাকসবজি খায়, কাজ করে, আর বেশিদিন বাঁচে।

নাকের ডগায় সানগ্লাস নামিয়ে প্লাস্টিক রিমের ওপর দিয়ে প্রু জর্জের দিকে তাকায়। বলে, ‘জর্জ, তোমার একেবারে লজ্জা নেই। সব সময় তুমি ছিলে…।‘ জর্জের দিকে নিস্পাপ হাসি দেয়, দুষ্ট হাসি দেয়। এমন হাসি যার মধ্যে সত্যিকারের অশুভ মোচড় খায়। এমন হাসি যা পানির ওপর গ্যাসের শিখার মতো জ্বল জ্বল করে, আভা বদলিয়ে ম্রিয়মান হয়।

প্রুর এই হাসিটা ছিল প্রথম মজার জিনিস যার ওপর জর্জ হোঁচট খায় পঞ্চাশের দশকের শেষের দিকে, যখন সে টরন্টোতে পা রাখে। ঘটনাটি ঘটে পূর্ব ইউরোপের এক রিয়াল এস্টেট ডিভেলপারের ডাকা পার্টিতে। তাকে নিমন্ত্রণ করা হয়, কারণ বিদ্রোহের ঠিক পরেই হাঙ্গেরির শরণার্থীদের তখন উল্লেখযোগ্য বিবেচনা করা হত। সেই সময়ে জর্জ ছিল তরুণ, সাপের মতো চিকন। এক চোখে ছিল দেখতে বিপজ্জনক ক্ষত, আর ছিল কয়েকটা অদ্ভুৎ গল্প। সংগ্রহে রাখার মতো। কাঁধ-খোলা পোশাকে প্রু সেখানে যায়। তার গ্লাসটি জর্জকে তুলে দিয়ে এর কিনারায় দিকে তাকায় এবং পতাকার মতো করে হাসিটাকে উত্তোলন করে।

হাসিটা এখনও একটা নিমন্ত্রণ। কিন্তু জর্জ তা টেনে নিয়ে বেড়াবে না—এখানে না, এখন না। পরে হয়ত শহরে। কিন্তু এই জলাশয়, এই উপদ্বীপ ওয়াকুস্টা লজ নিজেই তার আশ্রয়, তার মঠ, তার পবিত্র ভূমি। এখানে সে কিছু লঙ্ঘন করবে না।

জর্জ বলে, ‘উপহার নেওয়া তুমি সহ্য করতে পার না কেন?’ তার চোখে ধোঁয়া। চোখ ছোট হয়ে আসে। ‘আমার বয়স যদি কম থাকত, তবে নতজানু হতাম। বিশ্বাস কর, তোমার দু’হাতেই চুমু খেতাম।‘

প্রু গোড়ালিতে ভর করে ঘোরে। সে জানে আরও হঠকারী সময়ে এসব জিনিস জর্জ আগে করেছে। সে বলে, ‘মধ্যাহ্ন ভোজের সময় হয়েছে। এটাই তোমাকে বলতে এসেছিলাম।‘ সে প্রত্যাখান শুনেছে।

জর্জ দেখে নৌকা রাখার ঘর ছাড়িয়ে পাথরের পথ ধরে বাড়ি পর্যন্ত পাহাড়ের ওপরে পরিস্কার সূর্যালোকের মধ্য দিয়ে তার শাদা শর্টস ও এখনও সুডৌল উরু ( অবশ্য টোল পড়া চর্বির ক্ষীণ বিন্দুচিত্র) পিট পিট করছে। জীবনে এক বারের জন্য প্রু সত্য কথা বলছে।

পত্রিকায় আরেক বার চোখ বুলায় জর্জ। কুইবেক বিচ্ছিন্নতাবাদ নিয়ে আলোচনা করছে। মন্ট্রিয়ালের নিকটে ব্যারিকেডের পিছনে মোহাকরা আছে। আর লোকজন তাদের দিকে পাথর ছুড়ছে। কথা হচ্ছে দেশ ভেঙ্গে আলাদা হচ্ছে। জর্জ দুশ্চিন্তাগ্রস্ত নয়। সে এমন সব দেশে ছিল, যে সব দেশ আগে ভেঙ্গে আলাদা হয়েছিল। সুযোগ-সুবিধা থাকতে পারে। এখানকার লোকজন ভাষা নিয়ে যে গোলমাল করে তা সে বুঝে ওঠে না। দ্বিতীয় কিংবা তৃতীয় অথবা চতুর্থ ভাষা কী? রাশিয়ান ভাষা ধরলে জর্জ নিজে পাঁচটা ভাষায় কথা বলে। তবে রাশিয়ান ভাষায় কথা বলতে তুলনামূলক পছন্দ করে না সে। পাথর ছুড়ে মারাটা সাধারণ। বোমা নয়, বুলেট নয়, শুধু পাথরই তো। শোরগোলটাও এখানে নীরব করে দেওয়া হয়েছে।

তার পরনের ঢিলেঢালা শার্টের নিচে পেট চুলকায় সে। মাঝখানের চারপাশটা খুব বেশি বাড়ছে। তারপর সে সিগারেট নিভিয়ে স্কচের বোতলটি শেষ করে, আর ফোল্ডিং চেয়ার থেকে কষ্ট করে ওঠে। চেয়ারটি সাবধানে ভাঁজ করে নৌকা রাখার ঘরে রাখে। বাতাস এসে চেয়ারটি উড়িয়ে জলাশয়ে ফেলে দিতে পারে। ওয়াকুস্টা লজের জিনিসপত্র ও রীতিনীতি নম্রতা ও শ্রদ্ধার চোখে দেখে সে যা নগরে যারা শুধু তাকে চেনে তাদের হতবাক করে দেবে। কেউ কেউ তার প্রথাবিরোধী ব্যবসার কাজকে যা-ই বলুক না কেন, সে কোনও না কোনও ভাবে সংরক্ষণশীল একজন মানুষ। ঐতিহ্যকে সে ভালোবাসে। এ দেশের মাটিতে ঐতিহ্যের মূল্য নেই। কিন্তু যখন সে কোনও ঐতিহ্য দেখে, তখন তা জানে, আর শ্রদ্ধা করে। এখানকার ফোল্ডিং চেয়ারগুলো যেন অন্য জায়গার ঢাল।

যেমনটা অভ্যস্ত তার চেয়ে ধীরে ধীরে হেঁটে সে যখন পাহাড়ে ওঠে, তখন রান্নাঘরের পিছনে সে কাঠ ফেটে যাওয়ার শব্দ শোনে। জলাশয়ের পাশ দিয়ে চলে যাওয়া মহাসড়কে ট্রাকের আওয়াজ শোনে। শ্বেত দেবদারু গাছে বাতাসের শব্দ শোনে। লুন হাঁসের ডাক শোনে। প্রথম বার যখন শুনেছিল সেটা মনে করে সে এবং নিজেকে আলিঙ্গন করে। ভালো করেছে সে।

ওয়াকুস্টা লজটি বিশাল, আয়তাকার, এক তলা কাঠামোবিশিষ্ট। এর দেয়ালগুলি বোর্ড ও ব্যাটনের। রঙ কালো, লালচে ও বাদামি। পরিবারটির প্রপিতামহ শতাব্দীর শুরুতে এটি নির্মাণ করে। রেলওয়েতে তিনি বেশ টাকা-কড়ি বানান। লজের পিছনে কাজের লোকের ঘর ও বাবুর্চির ঘর রাখেন। যদিও জর্জের জানামতে কোনও কাজের মেয়ে কিংবা বাবুর্চিকে কখনও থাকতে দেওয়া হয়নি, অন্তত সাম্প্রতিক সময়ে তো নয়ই। ওয়াশরুমে কেবল একটি সিঙ্ক ও একটি বড় কলস আছে। সেখানে প্রপিতামহের বলিরেখাসমেত সিন্ধুঘোটকের মতো জুলফিওয়ালা মুখাবয়ব শক্ত একটা কলারের ওপরে ভ্রুকুটি মেরে ডিম্বাকৃতির ফ্রেমে ঝুলে আছে। জর্জের মনে আছে দস্তার বাথটবের কথা। কিন্তু তা অবসরে চলে গেছে। গোসলটা জলাশয়েই হয়। বাকিদের জন্য এক সারি চিরসবুজ বৃক্ষের পিছনে সুবিবেচনাপ্রসূতভাবে একটা বহিঃস্থ ঘর রাখা আছে।

জর্জ ভাবে, সেই সময়গুলোতে সাবানের বুদ্বুদ তুলতে তুলতে বৃদ্ধ লোকটি কতই না নগ্ন, অর্ধ-নগ্ন শরীর দেখে থাকবে। আর কীভাবেই না তাদের অগ্রাহ্য করে থাকবে। বুড়ো খোকাকে তো বহিঃস্থ ঘরে অন্তত পাঠানো হয়নি। এটা হলে তার জন্য বেশি বেশি হয়ে যেত। দরজা দিয়ে বের হওয়ার সময় জর্জ তার প্রপিতামহের প্রতি ছোট, কুসংস্কারপূর্ণ, অদ্ভুৎ একটা জাপানীজ প্রণতি জানায়। সব সময়ই সে এটা করে। এই ক্রুদ্ধ দৃষ্টির পূর্বপুরুষের টোটেমের উপস্থিতিই একটা কারণ যার জন্য সে কম-বেশি এখানে সঠিক আচরণ করে।

বাড়িটির সামনে পর্দা দিয়ে ঘেরা বারান্দায় মধ্যাহ্ন ভোজনের টেবিল প্রশস্থভাবে সাজানো আছে। এখান থেকেই নিচের জলাশয়টি দেখা যায়। প্রু টেবিলটিতে বসা নেই। তবে তার দু’বোন বসে আছে।  সবচেয়ে বড় জন শুষ্ক-মুখো পামেলা, আরেক জন নরম-সরম পোর্শিয়া। সে তিন বোনের সব চেয়ে ছোট এবং জর্জের বউ। আরও বসে আছে বিশালদেহী, গোলগাল ও টেকো ভাই রোলান্ড। নিখাদ সামাজিক উপলক্ষে জর্জ পুরুষদের অতটা অনুরাগী নয়। কারণ সে তাদের খুব কমভাবেই ব্যবহার করতে পারে। তো জর্জ রোলান্ডকে ভদ্র একটা প্রণতি জানিয়ে তার শেয়ালের হাসিটা পূর্ণ শক্তিতে দু’নারীকে দেয়। পামেলা যে তাকে অবিশ্বাস করে, সে সোজা হয়ে বসে না দেখার ভান করে। পোর্শিয়া তাকে দেখে হাসি দেয়। ব্যাকুল ও অস্পষ্ট একটা হাসি। মনে হয় জর্জ যেন এক খণ্ড মেঘ। রোলান্ড তাকে উপেক্ষা করে, যদিও উদ্দেশ্যপ্রসূতভাবে নয়। কারণ রোলান্ডের আছে গাছের অন্তর্লীন জীবন, কিংবা হয়তো কাণ্ডের জীবন। রোলান্ড কী ভাবছে অথবা আদৌ কিছু ভাবছে কিনা, জর্জ তা কখনই বলতে পারে না।

পামেলাকে জর্জ বলে, ‘আবহাওয়াটা চমৎকার না?’ সময়ের সাথে সাথে জর্জ জেনে গেছে যে কথোপকথনের জন্য আবহাওয়া দিয়ে শুরু করা উপযুক্ত বিষয়। পামেলা এত বেশি এভাবে বড় হয়েছে যে সরাসরি প্রশ্নের উত্তর সে অস্বীকার করতে পারে না।

সে বলে, ‘পোস্টকার্ড যদি পছন্দ কর, তাহলে অন্তত তুষার পড়বে না।‘ পামেলা সম্প্রতি নারী বিষয়ক ডীন নিযুক্ত হয়েছে। এ পদটি সম্পর্কে জর্জ এখনও পুরোপুরি ধারণা করতে পারেনি। অক্সফোর্ড ডিকশনারিতে সে পেয়েছে যে, মঠের দশ ভিক্ষুর প্রধান হচ্ছে ডীন, কিংবা ‘টেনম্যানিটেলের প্রধান পুরুষ যা টিওয়িং-ঈলডর এর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, অনু. মধ্য. এল. ডিক্যানাস’। পামেলা যা বলে তার অনেকটাই কম-বেশি এ রকম শোনায়—অবোধগম্য। যদিও গবেষণা করলে এর একটা অর্থ পাওয়া যেতে পারে।

জর্জ যে পামেলার সাথে বিছানায় যেতে চায় তা এ কারণে নয় যে, পামেলা সুন্দরী, জর্জের রুচির জন্য খুব বেশি সরলরৈখিক ও সমতল আকৃতির, কোনও নিতম্ব নেই, আর চুলগুলো শুকনো ঘাস রঙা। তবে এ কারণে যে, সে কখনই তার সাথে বিছানায় যায়নি। এছাড়া সে জানতে চায় পামেলা কী বলবে। পামেলার প্রতি তার আগ্রহটা নৃতাত্ত্বিক। কিংবা হয়ত ভূ-তাত্ত্বিক। হিমবাহের মতো করে তার ওপরে আরোহণ করতে হবে।


২য় পর্ব

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*